বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হইহই পড়ে গিয়েছিল গোটা পরিবারে। মেয়ে ঘরে ফিরেছে ঠিকই। কিন্তু এ কী অবস্থা তার? ডান চোখের চারিদিকে কালশিটের দাগ। চোখে প্রায় খুলছে না বললেই চলে। ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন তার মা। ভেবেছিলেন, ‘ছেলেদের খেলা’-য় আর পাঠাবেন না তাঁর মেয়েকে। ঠিক করে ফেলেছিলেন, বাড়িতে স্বামী ফিরলেই হেস্তনেস্তো করতে হবে এই বিষয়ের। নাহলে একদিন সন্তানের বিয়ে দেওয়াই যে দায় হয়ে দাঁড়াবে!
সেদিনের সেই আহত ছোট্ট মেয়েটিই আজ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। হ্যাঁ, নিখাত জারিন। তখন মাত্র ১২ বছর বয়স তাঁর। কয়েক সপ্তাহ হয়েছে বক্সিং রিং-এ যাআয়াত শুরু হয়েছে তাঁর। তার মধ্যেই এমন এক ঘটনা। সেদিন মায়ের রায় নিখাতের বিরুদ্ধে গেলেও, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাবা। হায়দ্রাবাদের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও ফুটবলার মহঃ জামিল চেয়েছিলেন চার সন্তানের মধ্যে একজন অন্তত লড়াই চালিয়ে যাক খেলার জগতে। কাজেই সর্বোতভাবে তাঁর সমর্থন ছিল জামিলের বক্সিং-প্রীতিতে। এমনকি আজ থেকে বছর ১৩ আগেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবেন তাঁর কন্যা।
হলও তেমনটাই। শেষ ১৪ বছরে বক্সিং বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে মেরি কমের পর ভারতকে সোনা এনে দিলেন তিনি। ফাইনালে থাইল্যান্ডের জিতপং জুতামাসকে ৫-০ ব্যবধানে হারিয়ে মাথায় পরলেন বিশ্বসেরার মুকুট। তবে শুধু ফাইনালই নয়, সবমিলিয়ে চারটি ম্যাচে ৫-০ ব্যবধানে জিতে নজির গড়লেন নিখাত। সোনার দৌড় থেকে ছিটকে দিলেন দু’জন পদকজয়ী অলিম্পিয়ান বক্সারকে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আকস্মিকভাবেই খেলার ময়দানে হাজির হয়েছিলেন নিখাত। বলতে গেলে, সেটা ছিল তাঁর মায়েরই সিদ্ধান্ত। কখনও গাছে উঠে আম পাড়া, কখনও আবার পাঁচিল টপকে লুকোচুরি খেলা— কিশোরী নিখাতের দস্যিপনায় তাঁর বাড়ি বয়ে অভিযোগ জানিয়ে যেতেন পাড়া প্রতিবেশীরা। বকাবকিতে লাভ হত না কিছুই। শেষ পর্যন্ত তাই বাবার সঙ্গে তাঁকে মাঠে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁর মা। তাঁর ইচ্ছেতেই শিলমোহর দিয়েছিলেন মহম্মদ।
আরও পড়ুন
উপার্জনের দায়ে অটো চালাচ্ছেন জাতীয় স্তরের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন
তবে মেয়েকে মাঠে নিয়ে গিয়ে মহম্মদ অনুভব করেছিলেন, অনায়াসেই অ্যাথলিট হতে পারে নিখাত। যথেষ্ট ভালো গতি রয়েছে নিখাতের। দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণও বেশ ভালো। এরপর বাবার তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় নিখাতের অনুশীলন। তবে ওই অ্যাথলিট হিসাবেই। স্কুলে ১০০ ও ২০০ মিটারের রেসে নিয়মিত পুরস্কারও আনতেন জারিন। বক্সিং-এ হাতেখড়ি এর আরও খানিকটা পরে। হায়দ্রাবাদের এই নিজাম সেক্রেটারিয়েট স্টেডিয়ামেই। এই স্টেডিয়ামেই বক্সিং-এর ক্লাস হত সমানভাবে। ‘এই খেলায় কোনো মহিলারা অংশ নেন না?’, এক বিকালে অনুশীলন করতে গিয়ে সরল মনেই বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন নিখাত। মহম্মদ আলির কন্যা লায়লার উদাহরণ দিয়ে বাবা জানিয়েছিলেন, সাহস থাকলেই বক্সিং রিং-এ নামতে পারেন যে কেউ। বক্সার হতে গেলে পুরুষ হতে হবে, এমনটা একেবারেই নয়।
আরও পড়ুন
১২৮ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু বক্সিং ডে টেস্ট, এমন নামকরণের কারণ কী?
সেখান থেকেই শুরু লড়াইয়ের। বাবার কাছে বক্সিং-এর হাতেখড়ি হয় জামিলের। বছর খানেকের মধ্যে নিখাত বক্সিং-এর পাঠ নেওয়া শুরু করেন ‘দ্রোণাচার্য’ ভেঙ্কটেশ রাও-এর কাছে। জয়যাত্রার শুরু সেই থেকেই। ২০১০ সালে তামিলনাড়ুতে ‘গোল্ডেন বেস্ট বক্সার’-এর মনোনয়ন পান নিখাত জারিন। ১৫ বছর বয়সে তুরস্কের মাটিতে যুব বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন; ২০১৪ সালে ১৭ বছর বয়সে নেশনস কাপ; ২০১৯-এ থাইল্যান্ড ওপেনে রুপো… সে এক দীর্ঘ তালিকা।
আরও পড়ুন
প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে টোকিও অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জন, মেরি কমের কাছে বয়স কেবল সংখ্যা মাত্র
তবে পাড়ায় নিখাতের দৌরাত্ম্য কমলেও থামেনি অভিযোগের তীর। মেয়ে হয়েও টিশার্ট-শর্টস পরে ময়দানে নামার মতো ‘অপরাধ’-এর জন্য একাধিকবার সমালোচনার শিকার হয়েছেন মহল্লায়। ধেয়ে আসত নানা ধরনের তীর্যক উক্তি। তবে তাতে গা ভাসাননি নিখাত। বরং, আরও জেদের সঞ্চার করেছে এই ঘটনা। আর খেলার জগতে?
সেখানেই সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে আহত হয়েছেন নিখাত। তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন স্বয়ং মেরি কমের কাছেই। যাঁকে কিশোর বয়স থেকেই নিজের আইডল মেনে এসেছেন নিখাত। ২০১৯ সালের কথা। কোনো বাছাই পর্ব ছাড়াই মেরি কমকে বিশ্ব বক্সিং-এ ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে বেছে নিয়েছিল বক্সিং ফেডারেশন। আর সেখানেই আপত্তি তুলেছিলেন তরুণ নিখাত। চিঠি লিখেছিলেন ফেডারেশনে। এই ঘটনার পর মিডিয়ায় শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেছিলেন মেরি কম। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কে নিখাত জারিন?’
এখানেই শেষ নয়। সেই বছরই অলিম্পিকের বাছাই পর্বে রিং-এ মুখোমুখি হন মেরি ও নিখাত। ৬-১ ব্যবধানে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল নিখাতকে। তবে খেলার শেষে নিখাত এগিয়ে গেলেও, আলিঙ্গন করতে অস্বীকার করেন মেরি। এমনকি বক্সিং রিং-এও একাধিকবার শব্দবাণে নিখাতকে বিধ্বস্ত করেছিলেন ৩ বারের স্বর্ণজয়ী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সেবার ম্যাচের পর ভেজা চোখেই স্টেডিয়াম ছেড়েছিলেন নিখাত জারিন।
কিন্তু কে নিখাত জারিন? তিন বছর পর যেন সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের জন্য স্বর্ণপদক ছিনিয়ে এনে। সরিতা দেবী, জেনি আরএল, লেখা সি ও মেরি কমের পর বক্সিং-এ পঞ্চম মহিলা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেল ভারত। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। এখন দেখার নিখাত জারিন মেরি কমের চূড়ান্ত সাফল্যকেও ছাপিয়ে যেতে পারেন কিনা…
Powered by Froala Editor