বেশ কয়েকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে নাইজেরিয়া। সম্প্রতি নাইজার প্রদেশের একটি আবাসিক স্কুল থেকে অপহৃত হয়েছিল ৩ শতাধিক ছাত্রী। তাদের সকলেরই মুক্তি মিললেও থেকে যাচ্ছে বেশ কিছু প্রশ্ন। কারণ বিগত কয়েক মাসে নয় নয় করে ঘটেছে সাত-আটটিরও বেশ অপহরণের ঘটনা। বর্তমানে যেন তা দৈনিক রুটিনে পরিণত হয়েছে নাইজেরিয়ায়। কিন্তু শুধুই কি সন্ত্রাসবাদীরাই দায়ী এই ঘটনার পিছনে? একেবারেই নয়। বেশ কিছু সমীক্ষার রিপোর্ট জানান দিচ্ছে, এর পিছনে যোগ রয়েছে প্রশাসনিক আমলাদেরও।
ফিরে যাওয়া যাক বছর ছয়েক আগে। ২০১৪ সালের কথা। নাইজেরিয়ার চিবোকে সেবারেও অপহৃত হয়েছিল ৩০০ ছাত্রী। এত বড়ো মাত্রার ছাত্র-ছাত্রীদের গণ-অপহরণ কার্যত সেই প্রথমবার সামনে এসেছিল মিডিয়ার দৌলতে। আর সেই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল নাইজেরিয়ার রাজধানী। মিটিং, মিছিল তো হয়েইছিল, পাশাপাশি তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেল ওবামাও প্রচারে নেমেছিলেন টুইটারে। হয়ে উঠেছিলেন ‘ব্রিং ব্যাক আওয়ার গার্লস’ ক্যাম্পেনের অংশ।
আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মুক্তিপণ দিয়ে সরকারই ছাড়িয়ে এনেছিল ছাত্রীদের। তবে সেই ঘটনায় যেন বাড়তি লাইমলাইটে চলে এসেছিল গণ-অপহরণ। সরকারের ওপরে সেই চাপই কাজে লাগিয়ে চলেছে অপহরণকারীরা। ২০১৪ সালের সেই ঘটনার পর থেকে কমপক্ষে ৪০টি অপহরণের সাক্ষী হয়েছে নাইজেরিয়ার বিভিন্ন আবাসিক স্কুল। অন্যদিকে আরও একটি কারণ হল নাইজেরিয়ায় কর্মসংস্থানের অভাব। আর্থিক পরিস্থিতি এবং সেইসঙ্গে বন্দুকের সহজলভ্যতা আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে পরিস্থিতি।
নাইজেরিয়ার সরকারি হিসাব দেখলে, ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ২ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে মুক্তিপণের খাতে। কিন্তু মুক্তিপণের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পুরোটায় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে চলে যায় না। নাইজেরিয়ার বিশ্লেষক এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের দাবি, এই অর্থ ভাগাভাগি হয়ে যায় স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে। শুধু রাজনৈতিক নেতারাই নন, পক্ষপাতদুষ্ট নাইজেরিয়ার পুলিশকর্মীরাও। আর সেই কারণেই বারবার নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রসঙ্গ উঠলেও নিষ্ক্রিয় প্রশাসন।
আরও পড়ুন
কখনও স্ত্রী-র ভয়, কখনও আবার স্বার্থসিদ্ধি; নিজেই নিজেকে অপহরণ করেছেন যে সব ব্যক্তি
অভিযোগ উঠছে খোদ রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়েও। পদক্ষেপ নিতে বলা হলেও সেই দায় তিনি বারবার বর্তে দিচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসকদের ওপরেই। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে আন্তর্জাতিক অনুদান নিয়েও। ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘ এবং যুক্তরাজ্যের দেওয়া বড়ো অঙ্কের আর্থিক অনুদান হাতে পাওয়ার পরেও বিন্দুমাত্র এগোয়নি প্রকল্পের কাজ।
আরও পড়ুন
বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেবেন ওষুধ; পাক বিমান অপহরণের চেষ্টা ফরাসি যুবকের
অপহরণকারীদের সঙ্গে যে আমলাতন্ত্রের যোগাযোগ রয়েছে, তা আরও স্পষ্ট হয়ে আসে ২০১২ সালের একটি ঘটনায়। নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী হিসাবে তখন দায়িত্বে ছিলেন ডঃ ওকোঞ্জো ইয়েওয়ালা। সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবেই কাজ শুরু করেছিলেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের এই প্রাক্তন ডিরেক্টর। তবে খুব বেশিদিন তিনিও চালিয়ে যেতে পারেননি এই কাজ। অপহৃত হয়েছিলেন তাঁর মা। গুনতে হয়েছিল ৬০ হাজার মার্কিন ডলার মুক্তিপণ। আর তারপরেই পদত্যাগ করেন তিনি। প্রতিবাদ করায় একই ঘটনা ঘটে নাইজেরিয়ান লেখক চিমামান্ডা এনগোজির সঙ্গেও।
আরও পড়ুন
প্রথমে অপহরণ, তারপর বলপূর্বক বিয়ে দেওয়া – মেয়েদের সঙ্গে এমন বর্বরতাই ‘প্রথা’ এই দ্বীপে
আশঙ্কার বিষয় হল, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের মোট অপহরণের ৩৭ শতাংশই ঘটেছে আফ্রিকার এই উপ-সাহারান অঞ্চলে। পাশাপাশি ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সবমিলিয়ে গত এক বছরে নিখোঁজ দেড়শোরও বেশি ছাত্রী। অর্থাৎ, যাদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। সমস্যা সমাধানের হাসি মুখে ঝুলিয়ে রাখলেও, সেই জায়গাতেও রয়ে গেছে ফাঁক। এই অরাজকতার শেষ কবে জানা নেই কারোর…
Powered by Froala Editor