শহরের যে-কোনো প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দেবে ওয়াটারবাস। সেখানে চলছে ওলা কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার জলযান। কয়েক মিনিট দূরত্বের ব্যবধানেই রয়েছে একের পর এক ফেরি ঘাট। আর সবচেয়ে বড় কথা শুধু পরিবহনই নয়, গোটা শহরটাই ভেসে রয়েছে জলের ওপরে। না, ভেনিস, বার্জেস বা লিনডাউয়ের মতো উন্নত ইউরোপীয় শহরের কথা হচ্ছে না। এই দৃশ্য খোদ আফ্রিকার। প্রতিবছর বন্যার হাত থেকে রেহাই পেতে এবার ভাসমান শহরে পরিণত হয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস।
লাগোস গোটা আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম শহর। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ বসবাস করেন নাইজেরিয়ার এই প্রাণকেন্দ্রে। তবে ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিগত কয়েক বছর ধরেই চাপ বাড়ছিল লাগোসের রাস্তাঘাট এবং পরিবেশের ওপর। প্রতিদিন প্রায় ৬-১০ হাজার টন বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় লাগোসে। তবে নেই সেইভাবে কোনো নিষ্পত্তির ব্যবস্থা। আর সেই কারণেই প্লাস্টিকজাত এই আবর্জনার জন্য বর্ষাকাল হলেই প্লাবিত হত লাগোসের রাস্তাঘাট। দুষ্কর হয়ে উঠত যান চলাচল।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বৃষ্টিপাতও। ফলে বাড়ছে বন্যার আশঙ্কাও। বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি রিপোর্টে দেখানো হয়, লাগোসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে নদীমাতৃক এই শহরের জলস্তর।
সমস্যার সমাধান করতেই ভাসমান শহরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে লাগোস। সড়কপথের বিকল্প হয়ে উঠে এসেছে নদীকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা। চালু হয়েছে ক্যানোয়ি এবং ওয়াটারবাস। বিনিয়োগ করছে ওলা, উবেরের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থারাও। ফলে অনেকটাই চাপ কমেছে যান চলাচলে। এবং উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে কার্বন নির্গমনও।
তবে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থাই নয়। শহরের পরিকাঠামোও ধীরে ধীরে বদল হচ্ছে লাগোসের। বছর দশ-পনেরো আগে নাইজেরিয়ান স্থপতি কুনলে আদেয়ামির দৌলতে নতুন রূপ পেয়েছিল লাগোসের মাকোকো শহর। প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যারেলের ব্যবহারে তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন মাকোকোর ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়। পিরামিডের আকারে তৈরি হওয়ার কারণে একদিকে যেমন স্থায়িত্ব বজায় ছিল এই নির্মাণের তেমনই গঠনের কারণে বৃষ্টির জল দাঁড়াত না বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে।
তবে ২০১৬ সালে সাইক্লোনের আঘাতে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয় এই স্থাপত্যের। তবে থেমে নেই উদ্ভাবনী। কেপ ভার্দে সাও ভিনসেন্ট দ্বীপে সম্প্রতি একই ধরণের নির্মাণে হাত লাগিয়েছেন আদেয়ামি। কাঠের ভাসমান কাঠামোর ওপরে তৈরি হচ্ছে তিন তিনটি ভাসমান বহুতল। মূলত এটি একটি ভাসমান মিউজিক হাব গঠনের প্রকল্প হলেও সেখানে রয়েছে প্রেক্ষাগৃহ, রেকর্ডিং স্টুডিও, পান্থশালা।
আরও পড়ুন
সমাধান করেছেন তিনশোরও বেশি কেস, কেনিয়ার ‘স্পাই কুইন’ জেন মুগো-র গল্প
অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ এবং সামুদ্রিক উচ্ছ্বাসের থেকে প্রতিরক্ষা হিসাবে আটলান্টিক মহাসাগরীয় উপকূলে তৈরি করা হয়েছে ৬০ ফুট উঁচু প্রাচীর। ৮.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীর লাগোসকে অনেকটাই সুরক্ষা প্রদান করছে বন্যার থেকে। পাশাপাশি আটলান্টিকের তীরে আরও ১৮টি এই ধরণের প্রাচীর নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে নাইজেরিয়া। ৭.২ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরগুলির মধ্যে থাকবে জল নিষ্কাশনের জন্য ৪০০ মিটারের ব্যবধান। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের জন্য খরচ হতে চলেছে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে জলস্তর বৃদ্ধি পাবে সারা পৃথিবীতেই। তবে তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ‘আফ্রিকার ভেনিস’। লাগোসের এই পাইলট প্রজেক্টই যে আগামী দিনে গ্রহণ করতে চলেছে সারা বিশ্বের তাবড় দেশগুলিও, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়েও বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা সমাধানের পথ দেখাচ্ছে নাইজেরিয়া…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সন্ত্রাসবাদের প্রকোপ চলবে আরও ২০ বছর, সতর্ক করলেন নাইজেরিয়ার সেনাপ্রধান