কোপেনহেগেনে বোর ইন্সটিটিউটের ল্যাবোরেটরিতে কাজ করছেন ব্যস্ত হেভেসি। হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন হেভেসির স্যার নিলস বোর। খবর পেয়েছেন জার্মান সেনা আক্রমণ করেছে ডেনমার্ক, রুটমার্চ করছে রাজপথ। গেস্টাপো ঢুকে পড়েছে কোপেনহেগেনের অলিতে-গলিতে। ল্যাবে ঢুকেই হেভেসিকে নির্দেশ দিলেন বোর, ‘এখনই গলিয়ে ফ্যালো নোবেলগুলো’।
হিটলার তখনও জার্মানির ‘ফ্যুয়েরার’ হয়ে ওঠেননি। বোরের চেয়ে বয়সে সামান্য বড়ো দুজন পদার্থবিদ; ম্যাক্স ভন লাউ ও জেমস ফ্রাঙ্ক জার্মানিতে স্বাধীনভাবে গবেষণা করছেন। একজন এক্স রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিমাপের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ও অন্যজন পরমাণুর উপর ইলেকট্রনের প্রভাব নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পান। অন্যদিকে ডেনমার্কে রাজধানী কোপেনহেগেনে বসে বোর পরমাণুর গঠন, কোয়ান্টাম থিয়োরির ধারণা ব্যাখ্যা করছেন। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার উদ্দেশ্যে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করেছেন ইন্সটিটিউট অফ থিয়োরিটিক্যাল ফিজিক্স (১৯২০), যার পরে নাম হবে নিলস বোর ইন্সটিটিউট। যেখানে কাজ করবেন ক্লেন, ক্র্যামার, হেভেসি, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের মতো বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীরা।
হিটলার ক্ষমতায় এলে অনেক ইহুদি বিজ্ঞানী জার্মানি ছেড়ে চলে যান। নাৎসি দর্শনের বিরুদ্ধাচরণ করায় কেউ কেউ জার্মানি থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। জার্মান নাগরিক হয়েও স্বয়ং আইনস্টাইন আমেরিকা থেকে আর জার্মানি ফিরে আসেননি। জার্মানি থেকে বিতাড়িত ইহুদি অথবা নাৎসি দর্শনের বিরোধী এ-সমস্ত বিজ্ঞানীদের প্রতি ছিল বোরের দুর্বলতা। তাই হিটলার বিরোধী বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন বোরের গবেষণাগার। বোর ইন্সটিটিউট প্রকৃত অর্থেই তাই ইহুদি বিজ্ঞানীদের শরণার্থী শিবির হয়ে উঠেছিল। লাউ ও ফ্রাঙ্ক তাঁদের দেশে হিটলার বিরোধী মতের সমর্থকরূপে পরিচিত ছিলেন। হিটলারের পেয়াদা গেস্টাপো যে-কোনো সময় তাঁদের নোবেল বাজেয়াপ্ত করতে পারে, এই ভয়ে তাঁরা বোরের ইন্সটিটিউটে তাঁদের নোবেল মেডেল পাঠিয়ে দিলেন।
৯ই এপ্রিল, ১৯৪০। উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ নাৎসি বাহিনী হিটলারের নেতৃত্বে আক্রমণ করে ডেনমার্ক। লক্ষ্য নরওয়ে আক্রমণ করার আগে নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা লাভ আর সাপ্লাই লাইন মজবুত করা। বোর জানেন, তাঁর সাধের ইন্সটিটিউট বহুদিন ধরেই নাৎসি গুপ্তচর আর গেস্টাপোদের নজরে আছে। তাই বাঁচাতে হবে ইন্সটিটিউটের সম্পদ আর তার সঙ্গে যুক্ত জীবনগুলিকে। চারিদিকে গোলাগুলি আর তোপের আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে আগে মনে পড়ল লাউ আর ফ্রাঙ্কের নোবেলের কথা। ২৩ ক্যারট সোনার চকচকে মেডেলের ওপর যে খোদাই করা আছে প্রাপকের নাম। শত্রুপক্ষের চোখে পড়বেই। জার্মানি থেকে সে-সময় যে কোনো ধরনের সোনা পাচার অপরাধ, তাই আবার নোবেল পাচার! লাউ ও ফ্রাঙ্কের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হলেন বোর।
আরও পড়ুন
ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনুরোধ, প্রস্তাব ফেরালেন আইনস্টাইন
ইন্সটিটিউটের ল্যাবে সেদিন কাজ করছিলেন একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত হাঙ্গারিয়ান বিজ্ঞানী জর্জ হেভেসি, যিনি নিজেও পরে রসায়নে নোবেল পাবেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন মেডেলগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলা হোক। কিন্তু বোর রাজি হলেন না, তিনি জানেন নাৎসি গুপ্তচররা কী ধূর্ত। তারা মাটি খুঁড়েও বার করে ফেলবে। হেভেসি এরপর নোবেলগুলো গলিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সোনা গলানো খুব সহজ কাজ নয়। সাহায্য নিলেন তাঁর রসায়নবিদ্যার কৌশলের। অম্লরাজে (তিনভাগ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ও একভাগ নাইট্রিক অ্যাসিডের মিশ্রণ) ডুবিয়ে দিলেন নোবেল। সোনার নোবেল ধীরে ধীরে প্রথমে বর্ণহীন, পরে রক্তিম আভাযুক্ত হলুদ ও সবশেষে ঊজ্জ্বল কমলা রঙের দ্রবণে পরিণত হল।
আরও পড়ুন
আইকিউ আইনস্টাইনের প্রায় দেড় গুণ, বিস্মৃতির অতলে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্ব
হিটলারের গেস্টাপো ল্যাবোরেটরি তন্ন তন্ন করে খুঁজল, ভাঙচুর করল। কিন্তু নজরে পড়লো না উঁচু শেল্ফে রাখা বিকারের মধ্যে কমলা দ্রবণ। আচমকাই হেভেসিকে চলে যেতে হয়েছিল অন্যত্র। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে স্টকহোম থেকে তিনবছর পর ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় ল্যাবোরেটরিতে। ক্ষত বিক্ষত ল্যাবে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন সেই অবিকৃত বিকার, অবিকৃত কমলা দ্রবণ। এবার আর দেরি নয়। উল্টো প্রক্রিয়ায় বার করলেন খাঁটি সোনা। ১৯৫০এর গোড়ার দিকে পাঠিয়ে দিলেন স্টকহোমের সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে। নোবেল ফাউন্ডেশন সেই সোনাকে পুনরায় নোবেল মেডেলের চেহারায় ফিরিয়ে আনল। আর তা সসম্মানে দ্রুত তুলে দিল লাউ ও ফ্রাঙ্কের হাতে (১৯৫২)।
আর ১৯২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী বোর তাঁর নিজের নোবেল মেডেল তুলে দিয়েছিলেন নিলামে। তবে আর্থিক লাভ বা ব্যবসার জন্য নয়, বরং এক মহান কাজে। ফিনিশীয় শরণার্থীদের ত্রাণের সাহায্যার্থে। নিলামে মেডেলটি কেনেন কোনো এক অজ্ঞাতনামা, যিনি পরে ফিরিয়ে দেন ফ্রেডরিকবর্গের ‘ড্যানিশ হিস্ট্রিক্যাল মিউজিয়াম’ কর্তৃপক্ষকে। যেখানে আজও দেখা যায় বোরের নামাঙ্কিত নোবেল মেডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় তিন তিনটি নোবেলের ভাগ্য তার প্রাপক বিজ্ঞানীদের মতোই ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা।
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
১. স্যাম কিন, দ্য ডিসঅ্যাপিয়ারিং স্পুন, ২০১০
২. https://www.nobelprize.org
৩. উইকিপিডিয়া
আরও পড়ুন
পরিবারের মধ্যেই গণিত নিয়ে রেষারেষি, বার্নৌলিদের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস
Powered by Froala Editor