ত্রিকোণাকার একটি প্রিজম। তার এক পিঠে এসে পড়েছে সাদা আলো। অন্য পিঠ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে রামধনু। এই দৃশ্য শুধু পদার্থবিদদের মধ্যেই জনপ্রিয় নয়। যাঁরা অল্প-বিস্তর গানের চর্চা করেও, তাদের কাছেও অত্যন্ত পরিচিত এই ছবি। পিঙ্ক ফ্লয়েড। প্রিজমের বর্ণালির মতোই রঙিন এক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই ব্যান্ডের সঙ্গে। একাধিক ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়েই পিঙ্ক ফ্লয়েড তৈরি করেছে এক মায়াবী মহাকাব্য। তবে গান বানাতে গিয়ে বার বার আর্থিক সংকটের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁদের। সেই পরিস্থিতির সামাল দিয়েই আবার সঙ্গীতজগতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন কিংবদন্তি সাইকিডেলিক তারকারা। সে ইতিহাস সকলের জানা থাকলেও, ব্রাত্য রয়ে গেছে একটি ফেরারির গল্প। হ্যাঁ, জনপ্রিয় গাড়ির ব্র্যান্ডের কথাই বলছি।
৮০-র দশকের কথা। ততদিনে সঙ্গীত জগতে নিজেদের জায়গা পাকা করে ফেলেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড। প্রকাশিত হয়ে গেছে জনপ্রিয় অ্যালবাম ‘ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন’, ‘দ্য ওয়াল’। তবে এই জনপ্রিয়তার মধ্যেও কোথাও যেন ভাঙন ধরেছিল গোটা ব্যান্ডের মধ্যে। ১৯৮৫ সাল। ব্যান্ড ছাড়লেন কি-বোর্ডিস্ট রিচার্ড রাইট এবং বেসিস্ট রজার ওয়াটারস। রজার আর রাইট— দু’জনই পিঙ্ক ফ্লয়েডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্যান্ডের স্বত্বের একটি বড়ো অংশের অংশীদার তিনি। ফলত তাঁর চলে যাওয়ায় শুরু হল আইনি প্রক্রিয়া। বড়োসড়ো অর্থনৈতিক ধাক্কা।
ব্যান্ডের মধ্যে এই বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৮৩-র একটি অ্যালবাম নিয়েই। ‘দ্য ফাইনাল কাট’। এই অ্যালবামের অংশ হতে পারেননি রিচার্ড রাইট। কারণ, সেসময় তাঁকে নির্বাসিত করেছে ব্যান্ড। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সাফল্য পেলেও, এই অ্যালবাম নিয়ে দ্বৈত প্রতিক্রিয়া ছিল সকল শ্রোতারই। কারণ, ততদিনে ‘দ্য ওয়াল’-এর স্বাদ এনে দিয়েছেন তাঁরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে এই অ্যালবামের জনপ্রিয়তা খানিকটা কমই বলা চলে।
অ্যালবাম প্রকাশের পর মুখ খুললেন গায়ক ও গিটারবাদক ডেভিড গিলমোর। জানালেন, অ্যালবামের অনেক গানই যোগ্য ছিল না প্রকাশের জন্য। পিঙ্ক ফ্লয়েডের দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যাওয়া কি এই মন্তব্যের জন্যই? জানা নেই। তবে গিলমোরের এহেন মন্তব্যে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন ওয়াটরস। কারণ, সব কটা গানেরই রচয়িতা তিনি। ওয়াটরস দাবি করলেন, গানের সুর ও মেটিরিয়ালের দিকে যথেষ্ট গাফিলতি ছিল গিলমোরের। নাহলে হয়তো, অ্যালবামটির মাত্রা একেবারেই অন্যরকম হত। এই বিবাদ বাড়তে বাড়তেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল পিঙ্ক ফ্লয়েড। না, আর কোনোদিন ব্যান্ডের সঙ্গে কোনো অ্যালবাম রেকর্ড করেননি ওয়াটরস।
আরও পড়ুন
১৯৬৬-তেই মৃত বিটলসের পল ম্যাক-কার্টনি, তাঁর হয়ে বেঁচে আছেন অন্য কেউ!
একদিকে যখন, অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত পিঙ্ক ফ্লয়েড; ঠিক এর পাশাপাশি অন্যদিকে তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে গ্ল্যাম রক। ক্রমে জনপ্রিয়তা বাড়ছে তার। আর ধীরে ধীরে সেই দৌড় থেকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে সাইকিডেলিক রক ও প্রোগ-রক। বাজারে টিকে থাকতে গেলে কোনো একটা স্ফুলিঙ্গ সেসময় অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল পিঙ্ক ফ্লয়েডের। সামনা-সামনি যতই বিবাদ থাকুক না কেন, ওয়াটারস আর রাইটকে ছাড়া গান বাঁধা যে সম্ভব নয়, তা বার বার স্বীকার করেছেন গিলমোর।
আরও পড়ুন
বিটলসের গান শুনতে শুনতেই বানাচ্ছেন মাস্ক, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই ৮৯ বছরের বৃদ্ধার
ঠিক এরকমই একটা সময় সুযোগ এল। ব্রিটিশ রেকর্ডিং সংস্থা ইএমআই-এর থেকে। ওয়ার্ল্ড ট্যুরের লোভনীয় অফার। কিন্তু বললেই তো আর ওয়ার্ল্ড ট্যুরের অংশ হয়ে ওঠা যায় না। বাদ্যযন্ত্র, রিহার্সাল প্যাড— সব কিছুই যে একেবারে নতুন থেকে শুরু করতে হবে আবার। খুঁজতে হবে নতুন সদস্যও। আর তার জন্য দরকার বিপুল অর্থ। সেই ছাদই যে ভেঙে পড়েছে পিঙ্ক ফ্লয়েডের মাথায়। অতএব উপায়?
আরও পড়ুন
আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান
১৯৮৬ সালে পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘মোমেনটারি ল্যাপস ফর রিসন’ ট্যুরটি যে সঙ্গীত ইতিহাসে বিশ্বের সবথেকে সফল বাণিজ্যিক ট্যুর— তা সকলেই জানি আমরা। তবে এই ট্যুরের ভবিষ্যৎ ও সাফল্যের বিষয়ে তখনও নিশ্চিত ছিলেন না স্বয়ং গিলমোর। ভেতরে চলছিল এক দোলাচল। ট্যুরে আর্থিক উপার্জন সেভাবে না হলে, যে বড়ো অঙ্কের দেনায় ডুবে যেতে হবে পিঙ্ক ফ্লয়েডকে। অতএব উপায়?
পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলেন ড্রামার নিক ম্যাসন। সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও আরেকটি গোপন পরিচয় রয়েছে তাঁর। হ্যাঁ, তিনি একজন অটো রেসার। রেসিং আর বিভিন্ন গাড়ির প্রতি ম্যাসনের আকর্ষণ চিরকালের। সেই সূত্রেই নিজের সমস্ত সঞ্চয় ভাঙিয়েই কিনে ফেলেছিলেন স্বপ্নের ফেরারি। ২৫০-জিটি। ম্যাসন সিদ্ধান্ত নিলেন, পিঙ্ক ফ্লয়েডের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই নিলামে তুলবেন সেই গাড়িকে। হলও তেমনটা। দাম উঠল ৪ কোটি মার্কিন ডলার। পিঙ্ক ফ্লয়েডের ঘুরে দাঁড়ানোর মূল চাবিকাঠিই ছিল ম্যাসনের ফেরারি সেই হাতবদল। অন্যদিকে শেষ অবধি ‘রাগ’ ধরে রাখতে পারেননি কি-বোর্ডিস্ট রিচার্ড রাইট। গিলমোরের ব্যক্তিগত অনুরোধে তিনিও ট্যুরের আগে যোগ দিয়েছিলেন ব্যান্ডে। কোনো লিখিত নথি না থাকলেও, ৮৬-র ওয়ার্ল্ড ট্যুরকেই ধরে নেওয়া হয় সঙ্গীত জগতের সবথেকে বড়ো প্রত্যাবর্তন হিসাবে। আর বাকিটা ইতিহাস…
Powered by Froala Editor