করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে তালা পড়েছে সমস্ত লাইব্রেরির দরজায়। শহরের মানুষদের কাছে প্রযুক্তি অন্যান্য বই পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে বটে। কিন্তু প্রান্তিক মানুষেরা? তাদের কথা ভেবেই এবার গ্রন্থাগার গড়ে তুলল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ঘুলঘুলি’। সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমার কাছে হরেন্দ্রনগরে গড়ে উঠল ‘ঘুলঘুলি’-র এই গ্রন্থাগার ‘বইঘর’।
তবে শুধুই কি লকডাউন সুযোগ কেড়ে নিয়েছে লাইব্রেরিতে গিয়ে বিভিন্ন বইয়ের স্বাদ নেওয়ার? নাকি তরুণ প্রজন্মও খানিকটা মুখ ঘুরিয়েছে বইয়ের থেকে? বর্তমান প্রজন্মের কাছে বইয়ের থেকে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ভিডিও গেম-ই বিনোদনের মূল জায়গা হয়ে উঠেছে। সেদিক থেকেও নতুনদের বইয়ের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যও এই উদ্যোগ।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, শহরে এই ঘটনা অনেকটা সত্যি হলেও প্রান্তিক অঞ্চলেও কি সামগ্রিক ছবি একই? যেখানে ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাসের জন্যই পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানেও বইয়ের প্রতি এই অনীহা? “শহরের ছেলে-মেয়েদের ইন্টারনেটের প্রতি একটা আসক্তি থেকেই যায়। এটা সত্যিই। সেখানে যে সময়টা তারা স্মার্টফোনে নষ্ট করছে, প্রান্তিক ছেলে-মেয়েরা সেই সময়টা কাটাছচে। নদী, পুকুরে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। তাই সামগ্রিক ছবিটা একই রকম দু’জায়গাতেই”, বাস্তব পরিস্থিতির ছবি ফুটে উঠল ঘুলঘুলির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস রায়ের কথায়।
তবে বর্তমান প্রজন্মের বইয়ের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার পিছনেও যে দায় তার আগের প্রজন্মের। সেকথাও মনে করিয়ে দিলেন তাপসবাবু, “বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ঠিক কতটা সেটা হয়তো অভিভাবকরা বোঝাতে পারছেন না সন্তানদের কোনোভাবে। ফলে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে বই পড়ার এই অভ্যেসটাই।” সেই অভ্যেসকে ফিরিয়ে আনার জন্যই এই প্রয়াস স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির। কিন্তু লাইব্রেরি থাকলেই কি গড়ে উঠবে বই পড়ার অভ্যেস? তাকে ফেরাতে দরকার নতুন করে আগ্রহ জাগানো তরুণদের মধ্যে। কীভাবে সম্ভব তা? সেই ক্ষেত্রেও এক অভিনব পন্থা নিল ঘুলঘুলি। পাঠকদের জন্য তাঁরা বন্দোবস্ত করেছে বিশেষ পুরস্কার। কোনো পাঠক ৬ মাসের মধ্যে পাঁচটি বই পড়তে পারলে, তাঁকে একটি বই উপহার হিসাবে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি।
তবে অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডের থেকে লাইব্রেরির উদ্যোগ খানিকটা হলেও আলাদা। বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য এবং নিজেদের সঞ্চয় ভাঙিয়েই সংস্থার সভ্যেরা গড়ে তুলেছিলেন ফান্ড। আর লাইব্রেরি তৈরির স্বপ্ন, পরিকল্পনা তো বহুদিনের। কিন্তু জায়গা? লাইব্রেরীর জন্য স্থায়ী কোনো ঘরের ব্যবস্থা যে আবশ্যিক। সেখানেও খুব একটা অসুবিধা হল না। উদ্যোগের কথা জানাতে বিনা দ্বিধায় এগিয়ে এল স্থানীয় একটি ক্লাব। লাইব্রেরির জন্য ঘর দেওয়া ছাড়াও ক্লাবের পুরনো আলমারি ব্যবহারের জন্যেও ঘুলঘুলিকে তুলে দিল ‘সবুজ সংসদ’। খানিক মেরামতি এবং কাচ বসানোর পর সেই আলমারিই হয়ে উঠল লাইব্রেরির বুক শেলফ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সেই ক্লাবেই শুরু হল ‘বইঘর’-এর পথ চলা।
আরও পড়ুন
লকডাউনে পড়ুয়াদের কাছে বই পৌঁছে দেবে ড্রোন, উদ্যোগ ভার্জিনিয়ার লাইব্রেরিয়ানের
তবে একদিনেই কি বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলা যায় তরুণদের মধ্যে? বরং ভারী চেহারার মোটা বই দেখলে উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ারই কথা তাঁদের মধ্যে। সেই সমাধানও খুঁজে বার করল ঘুলঘুলি। “রচনা সমগ্রের আকারের জন্যই অনেকে পিছিয়ে যায় বই পড়া থেকে। আমরা তাই ছোটো ছোটো গল্প, উপন্যাসের বই রাখার চেষ্টা করেছি লাইব্রেরিতে। তাতে অল্প অল্প করেই যেন গড়ে ওঠে সেই অভ্যেসটা। দিনে কেউ ৩ পাতা পড়লেও সেটা সাফল্য একটা”, জানালেন তাপসবাবু।
আরও পড়ুন
ঘরবন্দি দিনগুলোয়, ‘ইমার্জেন্সি লাইব্রেরি’তে কয়েক লক্ষ ই-বুক
তবে শুধু বইঘরই একমাত্র উদ্যোগ নয় ‘ঘুলঘুলি’-র। বরং বছর কয়েক আগে একটু অন্যরকমভাবেই শুরু হয়েছিল এই সংস্থার পথ চলা। টালিগঞ্জের মহাবীরতলা এনএসএইচএম ক্যাম্পাস থেকে। টিফিন, হাত খরচের টাকা বাঁচিয়েই দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিয়ালদা স্টেশনের বাইরের কিছু দরিদ্র পরিবারের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া দিয়েই শুরু। তারপর একের পর এক নতুন কাজে নেমে পড়া। পৌঁছে যাওয়া প্রান্তিক মানুষদের কাছে।
সব মিলিয়ে এখনও অবধি প্রায় ৪০টির মতো উদ্যোগ নিয়েছে ঘুলঘুলি। তার মধ্যে আমফানের ত্রাণ সাহায্য তো আছেই, এছাড়াও রক্তদান শিবির এবং সবুজায়নের প্রচেষ্টা লেগেই থাকে সারা বছর। টালিগঞ্জ ষ্টেশনের দুঃস্থ পথশিশুদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঘুলঘুলির সদস্য এই ছাত্রছাত্রীরাই। করোনা পরিস্থিতির জন্য রেশ পড়েছে সেই ক্লাসে। তবে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে সাহায্য। পাশাপাশিই পুরুলিয়ায় ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এক বাউল শিল্পী একটি স্কুল চালান। সেই স্কুলে একজন শিক্ষকের বেতন এবং আবাসিকদের জন্য প্রতিমাসে কিছু আর্থিক সাহায্যও পাঠিয়ে চলেছে ঘুলঘুলি।
আরও পড়ুন
রাস্তার ধারের লাইব্রেরিই হয়ে উঠছে প্যান্ট্রি, মানবিকতার বিরল ছবি আমেরিকায়
২০১৭ সালে যে ছোট্ট দলটা শুরু করেছিল এই কর্মযজ্ঞ, সেটাও বড়ো হয়েছে ধীরে ধীরে। দায়িত্ব নিয়েছেন কলেজের তরুণরাও। প্রাক্তনদের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই টের পাওয়া যাবে না ঘুলঘুলিতে গেলে। তেমনটাই জানাচ্ছেন তাপসবাবু। তবে আর থেমে থাকা কেন? ‘বইঘর’-কে শুধু সুন্দরবন পাবে এমনটা নয়। আরও বিভিন্ন প্রান্তিক জায়গাতেও আগামী দিনে গড়ে উঠতে চলেছে ‘ঘুলঘুলি’-র পাঠাগার। সেই লক্ষ্যই নিজেদের আরও শক্ত করে নিচ্ছেন তাপসবাবু এবং তাঁর স্বেচ্ছাসেবী টিম। ততদিনে ধীরে ধীরে বইপড়ার অভ্যেসও গড়ে উঠবে না কিছুজনের?
Powered by Froala Editor