তখন ক্রিকেট বলতে কেবল টেস্ট। সীমিত ওভারের ক্রিকেট সেভাবে তখনও চালু হয়নি বিশ্বজুড়ে। ১৯৩০ সাল। বিশ্বের পঞ্চম দেশ হিসাবে টেস্ট ক্রিকেট অভিষেক হল এক নতুন দেশের। নিউজিল্যান্ড। শুরুটা ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলেই। তবে প্রথম জয়ের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হল দীর্ঘ ২৬ বছর। ১৯৫৬ সালে এল প্রথম জয়। তাও যে-সে দল নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই অকল্যান্ডের মাটিতে হারাল ব্ল্যাক ক্যাপ। পর পর তিন তিনটে ম্যাচে। সেই দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন বিখ্যাত কিউয়ি ক্রিকেটার জন রেইড। যাঁর হাত ধরেই বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। গত পরশু প্রয়াত হলেন সেই প্রাক্তন ক্রিকেট তারকাই।
নিউজিল্যান্ডের জীবিত প্রবীণতম টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন জন রেইডই। পৃথিবীর প্রথম পাঁচ প্রবীণতমের মধ্যেও ছিল তাঁর নাম। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বার্ধক্যজনিত সমস্যা থাকলেও শেষ বয়সেও তেমন কোনো গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে যান নি রেইড। তাঁর মৃত্যুর কারণও সঠিকভাবে জানানো হয়নি তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে।
নিউজিল্যান্ড যখন প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মাঠে নামছে, তার বছর দুয়েক আগে ১৯২৮ সালে জন্ম রেইডের। অকল্যান্ড শহরে। ক্রিকেট নিয়ে ছোটো থেকেই উন্মাদনা তো ছিল। শুরু হল তাকে আয়ত্ত করার অনুশীলন। তবে প্রথমে বোলিংকেই নিজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন রেইড। অনুশীলন, অনুশীলন আর অনুশীলনের মাধ্যমেই হয়ে উঠেছিলেন নিউজিল্যান্ডের অন্যতম আক্রমণাত্মক ও শক্তিশালী পেস বোলার। পরে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় সেই বোলিং অ্যাকশনই। সংক্ষিপ্ত দৌড়ে স্পিন এবং ঘাতক অফ-কাটারের ব্যবহার করতেই দেখা গিয়েছিল তাঁকে পরবর্তী সময়ে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই অভিষেক হয় জন রেইডের। তখন উইকেট-কিপারের ভূমিকাতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। রয়েছে ৪৩টি আন্তর্জাতিক ক্যাচ। আর বোলিং কেরিয়ারে তাঁর সংগ্রহ ৮৫টি আন্তর্জাতিক উইকেট। ঘরোয়া প্রথম সারির ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ৪৬৬টি উইকেটের শিকারি রেইড।
তবে রেইড বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন ক্রিকেট মাঠের যেকোনো ফর্মেই তিনি মানিয়ে নিতে পারেন দ্রুত। ব্যাট হাতেও রীতিমতো বিপক্ষের ত্রাস ছিলেন রেইড। ২৪৬টি প্রথম সারির ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১৬১২৮ রান। গড় ৪১.৫। রয়েছে ৩৯টি ঝকঝকে শতরানও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৪০ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস গড়ে তুলেছিলেন রেইড। সেটা ছিল ১৯৬১ সাল।
তার চার বছর পরে ১৯৬৫ সালেই অবসর গ্রহণ করলেন নিউজিল্যান্ডের দাপুটে অল-রাউন্ডার। তবে ততদিনে তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে বিখ্যাত ‘কুইন’স বার্থডে অ্যাওয়ার্ড’, ‘উইসডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’, ‘অর্ডার অফ মেরিট’। খেলা থেকে অবসর নিলেন তবে ক্রিকেটের সঙ্গে রয়েই গেল তাঁর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নাড়ির টান এভাবে মুছে যেতে পারে কি?
আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?
ব্যক্তিগত জীবনে চিরকালই মজার চরিত্র ছিলেন রেইড। ১৯৬৯ সালে পৃথিবীর প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছেন দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে। সেখানেই ঘটিয়ে বসেছিলেন এক মজার ঘটনা। প্রতিটা শটই মেরেছিলেন উত্তর দিকে। ছয় মেরে বলও হারিয়ে দিয়েছিলেন সেই ম্যাচে। প্রেমিক হিসাবেও একজন অদ্ভুত মানুষ ছিলেন রেইড। ১৮ বছর বয়সে তখন সবে অভিষেক হয়েছে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। রিউম্যাটিক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন রেইড। আর সেখানেই প্রেমে পড়লেন এক নার্সের সঙ্গে। বছর পাঁচেকের মধ্যেই বিয়ে। নরলি রেইডের সঙ্গেই তাঁর শেষদিন অবধি একইসঙ্গে থেকেছেন বিখ্যাত এই ক্রিকেট তারকা।
রেইডের মধ্যে চিরকালই ছিল নতুন কিছু করে দেখার আগ্রহ। খেলা ছেড়ে তৈরি করলেন স্কোয়াসের কোম্পানি। আর তাঁর তৈরি সেই স্কোয়াসই পৌঁছে যেত নিউজিল্যান্ডের সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে। খেলোয়াড়দের জন্য। ১৯৭৫ সালে তাঁর কাছেই দ্বারস্থ হল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। তাঁকে হতে হবে জাতীয় দলের নির্বাচক। হলেনও তিনি। ৩ বছর একটানা পালন করলেন সেই দায়িত্ব। তবে এদিকে স্কোয়াসের ব্যবসা লাটে উঠল। ৭০ দশকের শেষ দিকে সেই কোম্পানিই ব্রিক্রি করে দিলেন রেইড।
১৯৮১ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের কোচ হিসাবে নিযুক্ত হলেন রেইড। ১৯৯২ সালে ফিরলেন নিউজিল্যান্ডে। ১৯৯৩ থেকে শুরু হল আরেক নতুন দিকে যাত্রা। ম্যাচ রেফারি। আম্পায়ার। আন্তর্জাতিক স্তরে ৫০টি টেস্ট ম্যাচ এবং ৯৮টি ওয়ান-ডে ম্যাচে আম্পায়ারিং করেছেন রেইড। সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা
সব মিলিয়ে এক বর্ণময় জীবন। রেইডের মতো এমন রঙিন চরিত্র ক্রিকেটের দুনিয়ায় দেখা গেছে খুব অল্পই। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হল একটা বিস্তীর্ণ অধ্যায়। বলাই বাহুল্য, এমন এক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ক্রিকেট দুনিয়া। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড এবং আইসিসিও...
তথ্যসূত্রঃ
১। উইকিপিডিয়া
আরও পড়ুন
২৩০ বছর পেরিয়ে, কেমন আছে 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব'?
২। John Reid obituary - Peter Mason - The Guardian
Powered by Froala Editor