আগ্নেয়গিরি (Volcano), শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে যায় অগ্নিদেবের শয্যা অর্থাৎ আফ্রিকার ওলডোনিও লেঙ্গাইয়ের কথা। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর সেই অগ্ন্যুৎপাতের (Volcanic Eruption) বর্ণনায় আতঙ্কের সঙ্গে মিশে গিয়েছে সম্ভ্রমও। তবু আগ্নেয়গিরি মানেই ধ্বংসের কারণ, এমনটাই মনে করেন সকলে। অথচ এই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির পিছনেও আগ্নেয়গিরির ভূমিকা কিছু কম নয়। আজও এক একটি অগ্ন্যুদ্গারের পর সেই অঞ্চলে পুরনো বাস্তুতন্ত্র মুছে গিয়ে নতুন করে বাস্তুতন্ত্র রচনার কাজ শুরু হয়। আগ্নেয়গিরির লাভার মধ্যেই কীভাবে জীবনের বীজ প্রবেশ করে, তাই নিয়েই গবেষণা শুরু করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ আরিজোনার গবেষক সোলাঞ্জি দোহামেল। প্রায় এক বছর আগে গবেষণা শুরু করেছেন তিনি। তবে গত মার্চে আইসল্যান্ডের ফাগ্রাদলসজল আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুদ্গারের পর তাঁর পক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা আরও সহজ হয়েছে। আর যত বেশি তথ্য সংগ্রহ করছেন, ততই নিজে অবাক হচ্ছেন। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন সোলাঞ্জি।
এই পৃথিবীর শিলাস্তরের ৮০ শতাংশই তৈরি হয়েছে আগ্নেয় বিষ্ফোরণ এবং লাভা অগ্ন্যুদ্গারের ফলে। আর শিলামণ্ডলকে ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের কল্পনাই করা যায় না। ফলে পৃথিবীতে জীবনের উদ্ভবের পিছনেও আগ্নেয়গিরিগুলির ভূমিকা কিছু কম নয়। কিন্তু লাভার উত্তাপে ছাই হয়ে যাওয়া প্রান্তরে কীভাবে নতুন করে জীবনের সূত্রপাত হয়, তার সম্পূর্ণ হদিশ এখনও বিজ্ঞানীরা জানেন না। সোলাঞ্জির গবেষণা সেই রহস্যের পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। অগ্ন্যুৎপাতের সময় ভূগর্ভ থেকে যে লাভা বেরিয়ে আসে, তাতে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ থাকে বিপুল পরিমাণে। কিন্তু প্রাণ ধারণের জন্য তার সঙ্গে প্রয়োজন নাইট্রোজেন। লাভার মধ্যে কোনো নাইট্রোজেন থাকে না। অতএব শুরুতে এমন কোনো জীবের প্রয়োজন, যা বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে শিলাস্তরে গেঁথে দিতে পারবে। সোলাঞ্জি ইতিমধ্যে সেই জীবের সন্ধান পেয়েছেন। আর সেটা আর কিছু নয়, লিচেন। শৈবাল আর ছত্রাকের মাঝামাঝি এই উদ্ভিদ প্রথমেই তার রঙের বাহারে রাঙিয়ে দেয় লাভায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া উপত্যকাকে।
লিচেন জন্ম নেওয়ার পর কীভাবে আরও জটিল জীবের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেটা এখনও পরীক্ষাধীন। তবে সোলাঞ্জি সবচেয়ে অবাক হয়েছেন অন্য একটি বিষয় থেকে। শুধুমাত্র লাভাগঠিত উপত্যকার উপরিপৃষ্ঠেই বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে না। লাভার স্তরের নিচে যেখানে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়, সেখানেও প্রাণের সঞ্চার হয় ক্রমশ। প্রথম অ্যাজিনোব্যাক্টোর জাতীয় ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু। তারপর শ্বেত প্রবাল পর্যন্ত জন্ম নেয় লাভাস্তরের নিচে। খালি চোখে তাদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। কিন্তু সোলাঞ্জি অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে সেই উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখেছেন। ধ্বংসের প্রতিভূ আগ্নেয়গিরিগুলিই যেভাবে জীবনের চক্রকে সচল রেখেছে, সে-কথা ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। বিজ্ঞানের প্রায় অনালোচিত এই অধ্যায়ে মিলেমিশে যায় ভূতত্ত্ব এবং জীবন বিজ্ঞান। সোলাঞ্জির এই গবেষণা তাই নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Powered by Froala Editor