সভ্যতার বয়স কয়েক হাজার বছর, এমনই বিশ্বাস ছিল পুরো অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ জুড়েই বসবাস করা আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের ঘিরে। তবে ইতিহাস কবে কোথায়ই বা থেমে থেকেছে? সদ্য পাওয়া প্রমাণ থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই মহাদেশের মরুভূমিতে এই উপজাতিদের অস্তিত্ব যা ভাবা হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি পিছনে। পৃথিবীর আদিমতম সভ্যতাও বলা হচ্ছে এই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান সভ্যতাকে।
বংশগতির নিরিখে এই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানরা ৫৮০০ বছর আগে জেনেটিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। হাজার হাজার বছর আগের সেই পৃথিবীতে অন্যান্য পূর্বপুরুষ গোষ্ঠীগুলিরও আগে তারা তৈরি করে ফেলেছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। তবে বছর দুই আগের একটা সমীক্ষায় সামনে আসে যে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ মরুভূমিতে যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তা এই গোষ্ঠীর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে কম করে আরও ১০ হাজার বছর। নতুন এই মত মান্যতা পেয়েছে সম্প্রতি আরও একবার, যেখানে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই গোষ্ঠী অন্তত ৫০,০০০ বছর ধরে বসবাস করে চলেছে অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলে।
কর্নটুকুলের মরুভূমির শিলা সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৫,০০০ পাথরের নিদর্শন পরীক্ষা করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে পাওয়া গিয়েছে একটা পাথরের ফলা, যার প্রান্তটি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সরঞ্জামটি বর্শা হিসাবে বা কাঠ প্রক্রিয়াকরণের জন্য যন্ত্রপাতি হিসাবে ব্যবহার করা হত। এটির ব্যবহারই প্রমাণ করে যে, প্রাচীণ মরুভূমির লোকেরা প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে ছিল না। বরং তাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল আকর্ষণীয়। কারণ, এই মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সময় তাঁরা যেমন বিভিন্ন বন্যপ্রাণের সম্মুখীন হত, তেমনই মুখোমুখি হয়েছিল নানা ধরণের বাস্তুতন্ত্রের।
এই সরঞ্জামটি প্রায় ৪৩ হাজার বছর পুরানো বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা, যা তার অনুরূপ সরঞ্জামগুলির তুলনায় কম করে ১৫ হাজার বছর বেশি পুরনো। এখান থেকেই বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস যে, এই আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরা কেবলমাত্র অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে বসবাসকারী প্রথম ব্যক্তিই ছিলেন না, বরং সমগ্র বিশ্বের যে-কোনো জায়গায় প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন তাঁরাই।
বিজ্ঞানীদের বক্তব্য অনুযায়ী, আদিম পূর্বপুরুষদের দুটি দল তত্কালীন আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তারাই ছিল সম্ভবত সমুদ্র অতিক্রমকারী প্রথম দল ছিল, যারা আধুনিক কালের তাসমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ গিনির সমন্বয়ে গঠিত উপমহাদেশের দিকে যাত্রা করেছিল তাদের অভিবাসনের সময়। সেই কারণেই হয়তো আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য আশ্চর্যজনক, মত বিজ্ঞানীদের। দীর্ঘদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার ফলে এই মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিটি আদিবাসী গোষ্ঠী এই অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে স্বতন্ত্র উপায়ে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা তুলে এনেছেন ভৌগলিক ব্যাখ্যাও। অস্ট্রেলিয়ার অঞ্চলটি বিশাল। আদিবাসীরা এই মহাদেশটি অতিক্রম করার পর কিছু দলে ভাগ হয়ে গিয়ে একেক গোষ্ঠী একেক জায়গায় অবস্থান করতে শুরু করে। এভাবেই ক্রমাগত নতুন জায়গার সন্ধানে চলতে চলতে এক সময় এই দলগুলি ভৌগোলিকভাবে একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে যায়। আলাদা হয়য়ে যায় পরবর্তীকালে একে অপরের থেকে জেনেটিকভাবেও।
আরও পড়ুন
সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই গোমাংস ভক্ষণের রেওয়াজ ছিল ভারতে, জানাচ্ছে গবেষণা
পরবর্তীতে বিদেশি উপনিবেশ যথারীতি আঘাত হেনেছিল এই সভ্যতাতেও। প্রায় আড়াইশো বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের সময়, ২০০টিরও বেশি বিভিন্ন আদিবাসী ভাষার অস্তিত্ব ছিল। সেই সঙ্গে ছিল কয়েক শতাধিক উপভাষা। কিন্তু বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের অত্যন্ত দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও, বর্তমানে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত ভাষাটি মাত্রই চার হাজার বছরের পুরনো। তবুও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এখনও বিশ্বের অন্যতম বৈচিত্র্যময় এবং রহস্যময় সভ্যতা। স্বাভাবিক ভাবেই তাই, এটা শুধু পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতিই নয় বরং গোটা মানব ইতিহাসেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
Powered by Froala Editor