পৃথিবীর বুকে মহাসাগরের সংখ্যা ৪। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এমনটাই শিখত কিশোররা। তবে গত বছর বদলে যায় সংখ্যাটা। দক্ষিণ মেরুকে কেন্দ্র করে থাকা জলরাশিকে পৃথিবীর পঞ্চম তথা ‘দক্ষিণ মহাসাগর’ হিসাবে স্বীকৃতি দেন গবেষকরা। এবার আরও একটি মহাসাগরের (Ocean) হদিশ পেলেন ভূবিজ্ঞানীরা। না, পৃথিবীপৃষ্ঠে নয়, বরং এই মহাসাগর লুকিয়ে রয়েছে ভূগর্ভে (Underground)।
অবাক লাগলেও সত্যি। ভূপৃষ্ঠের ৪০০ থেকে ৬৬০ কিলোমিটার নিচে লুকিয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড এক জলের ভাণ্ডার। বৎসোয়ানা থেকে প্রাপ্ত একটি হিরের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই আশ্চর্য রিজার্ভারের সন্ধান পেলেন গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁদের কথায় এই রিজার্ভারই বিশ্বের ষষ্ঠ মহাসাগর। যা নাকি ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত আমাদের পরিচিত পাঁচ মহাসাগরের সম্মিলিত আয়তনের প্রায় তিনগুণ। প্রশ্ন থেকে যায়, এই বিপুল জলরাশি পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের নিচে আটকে পড়ল কীভাবে? পাশাপাশি পৃথিবীর কেন্দ্র উত্তপ্ত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে জলের এত বড়ো ভাণ্ডার রয়েছেই বা কীভাবে?
এক এক করে উত্তর দেওয়া যাক রহস্যগুলির। প্রথমত, বহু গবেষকই এতদিন মনে করতেন, প্রকাণ্ড বরফের ধূমকেতু পৃথিবীকে আঘাত করার ফলেই জন্ম নিয়েছিল মহাসাগরের। তবে গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে অন্য কথা। ধূমকেতু পৃথিবীকে আঘাত করেছিল ঠিকই। সেই সংঘর্ষের কারণে তৈরি হয়েছিল প্রকাণ্ড গর্ত অর্থাৎ ‘সিবেড’। কিন্তু মহাসাগরীয় জল-এর উৎস আসলে ভূগর্ভস্থ জলই। আঘাতের কারণে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ এই জলভাণ্ডার থেকেই জল বেরিয়ে এসেছিল সে-সময়।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। পৃথিবীর ম্যান্টেলের উপরিতল এবং অভ্যন্তরীণ স্তরের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে ট্রাঞ্জিশন জোন হিসাবে ধরেন গবেষকরা। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০-৬৬০ কিমি গভীরে অবস্থিত এই অঞ্চলেই পাওয়া যায় পেরিডট নামের একটি বিশেষ খনিজ। খনিজ না বলে তাকে রত্ন বা স্ফটিক বলাই ভালো। উচ্চ জলধারণ ক্ষমতা রয়েছে জলপাই রং বিশিষ্ট এই রত্নের। পাশাপাশি নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উজ্জ্বল, স্বচ্ছ, নীল বর্ণের, একই চরিত্রের ‘রিংউডাইট’ নামের আরও একটি স্ফটিকের সন্ধান পেয়েছেন এই অঞ্চল থেকেই।
উল্লেখ্য, এই ধরনের খনিজের মধ্যেই সঞ্চিত রয়েছে প্রচুর পরিমাণে জল। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ স্টিভেন জ্যাকবসন জানাচ্ছেন, এইধরনের স্ফটিকগুলি বাইরে নিয়ে এলেই তা থেকে জল বের হতে শুরু করে। কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘটনার কারণ কী? গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক ব্রেনকার কথায়, পৃথিবীর কেন্দ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় উচ্চ তাপ এবং চাপে প্রচুর পরিমাণ জল শোষণ করতে পারে এই ধরনের স্ফটিক। পৃথিবীপৃষ্ঠে নিয়ে আসা হলেই ক্রমশ ভেঙে যায় তাদের রাসায়নিক গঠন। জলের অণু বিচ্ছিন্ন হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মূল স্ফটিকের আণবিক গঠন থেকে। সেই সঙ্গে তৈরি হয় প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইডও।
আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে জুলে ভার্ন কল্পনা করেছিলেন পৃথিবীর অভ্যন্তরে রয়েছে এমনই একটি আশ্চর্য সমুদ্র। তাঁর বর্ণিত বহু কল্পবিজ্ঞানের যন্ত্রের মতোই, এই ভবিষ্যদ্বাণীও মিলে গেল কাঁটায় কাঁটায়। অবশ্য ‘নেচার জিওসায়েন্স’ পত্রিকায় এই গবেষণা প্রকাশিত হলেও এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গবেষকদের স্বীকৃতি পায়নি ষষ্ঠ মহাসাগরের এই অস্তিত্বের কথা। তবে এ-কথা মানতেই হয়, এই গবেষণার সৌজনেই খুলে গেল ভূবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত…
Powered by Froala Editor