নেশার বা মাদকাসক্তির সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই সৃজনশীলতার। তবে বহু শিল্পীরই বিশ্বাস, নেশা কিংবা মাদকগ্রহণ সৃজনসৃষ্টির সময় অনুঘটকের মতো কাজ করে। বব মার্লে থেকে বিলি আর্মস্ট্রং, উইলিয়াম ব্লেক থেকে পাবলো পিকাসো— নেশারুর তালিকায় অনায়াসেই পাওয়া যায় কিংবদন্তি শিল্পীদের নাম। তবে আজ নয়, প্রাচীনকাল থেকে শিল্পীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ‘নেশা’-র। অন্তত সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে তেমনটাই। ‘নেশাগ্রস্ত’ (Getting High) অবস্থাতেই গুহাচিত্র আঁকত আমাদের পূর্বপুরুষরা (Ancient Human)।
বছর খানেক আগের কথা। ফ্রান্সের একটি গুহায় আবিষ্কৃত বেশ কিছু গুহাচিত্র পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন ইজরায়েলের তেল-আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও প্রত্নতাত্ত্বিক ইয়াফিট কেদার। তবে মাটি থেকে কয়েক ফুট গভীর অবস্থিত এই গুহায় অন্য একটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর। প্রথমত, এই গুহা প্রাচীনকাল থেকেই ডুবে থাকত চির-অন্ধকারে। পাশাপাশি সেখানে অক্সিজেনের মাত্রা অস্বাভাবিকরকমের কম। বায়ুমণ্ডলে গড় অক্সিজেনের মাত্রা ২০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে ক্রমশ পর্বতে উঠতে থাকলে কমে যায় সেই মাত্রা। একইভাবে স্যাঁৎস্যাঁতে গভীর গুহাতেও অক্সিজেনের মাত্রা থাকে স্বাভাবিকের থেকে কম।
ডঃ কেদার পরীক্ষা করে দেখেন ফ্রান্সের গুহাটিতে অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র ১২ শতাংশ। অথচ, ১৪.৩ শতাংশের কম অক্সিজেন-যুক্ত বায়ুমণ্ডলেই মানুষের শরীরে দেখা দেয় হাইপোক্সিয়া নামের এক বিশেষ অবস্থা। অতিরিক্ত মদ কিংবা মাদকসেবন করলে মানুষ যেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, হাইপোক্সিয়ার উপসর্গও তেমনই। বা বলা ভালো, মাদকসেবনের কারণে দেহে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে হাইপোক্সিয়ায় আক্রান্ত হয় মানুষ।
এই বিষয়টিই ভাবিয়ে তোলে ইজরায়েলি গবেষককে। তবে কি প্রাচীনকালে নেশাগ্রস্ত হওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই গুহার অভ্যন্তরীণ প্রান্তকে বেছে নিত শিল্পসৃষ্টির জন্য? হ্যাঁ, তেমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা। কারণ, গুহার বাইরের অংশের পাথরের দেওয়ালে কোনো ছবিই আঁকেনি আমাদের পূর্বপুরুষরা। বরং, তাঁদের পছন্দের জায়গা ছিল গুহার সবচেয়ে দুর্গম কোণগুলি।
এ তো গেল প্রস্তুরযুগেরও আগের। গ্রিসের পৃথক একটি গবেষণাও সমর্থন করছে ইজরায়েলের গবেষকদের প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটিকে। তাঁদের গবেষণায় ধরা পড়েছে, পুজো-অর্চনার আগে আগ্নেয়গিরির নিকটবর্তী অঞ্চলে মাটির ফাটল বেরিয়ে আসা গ্যাসের গন্ধ নিতেন সেখানকার পুরোহিত তথা ওরাকেলরা। আদতে এই গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মিশ্রণ। যার প্রভাবেও দেখা দেয় হাইপোক্সিয়া। অর্থাৎ, মাদক কিংবা সুরা আবিষ্কারের আগে থেকেই মানব সভ্যতা অভ্যস্ত ছিল প্রাকৃতিক নেশায়। তত্ত্ব, লোককথার বাইরে গিয়ে এমনটাই এবার প্রমাণিত হল খাতায়-কলমে…
Powered by Froala Editor