গত বছরের মে মাসের কথা। অসমের বাঘজানে ওয়েল ইন্ডিয়া’র একটি প্রাকৃতিক তেলের কুয়োয় ঘটে যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। তৈল উত্তোলনের পাইপ ফেটে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রাকৃতিক গ্যাস। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটে অগ্নি-সংযোজন। জুন থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত— টানা ৬ মাস ধরে অব্যাহত ছিল সেই অগ্নিকাণ্ড। এই বিপর্যয় যে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে প্রকৃতিতে— তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না কোনো। কিন্তু কতটা? এবার উত্তর মিলল তার। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাল, প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির ৭০-৮০ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতেও এক দশকের বেশি সময় লেগে যাবে বাঘজানের।
অসমের বনবিভাগের কর্মকর্তা মহেন্দ্র কুমার যাদব এবং অসম কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বাঘজান দুর্ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের ওপর সম্প্রতি একটি বিস্তারিত সমীক্ষা চালান। তাতেই উঠে আসে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই প্রতিবেদনেই উল্লেখিত হয়েছে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। আর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে বাঘজানের সময় লেগে যাবে দু’দশকেরও বেশি। কারণ, একদিকে যেমন আকস্মিক বেড়ে গেছে কার্বন নির্গমণের মান, তেমনই হ্রাস পেয়েছে গাছের সংখ্যাও।
বাঘজানের সেই অভিশপ্ত তৈল কূপটির হাজার মিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত ডিব্রু সাইখোয়া জাতীয় উদ্যান এবং মাগুড়ি-মোটাপুং বিল। যা শুধু পরিযায়ী পাখিদেরই নয়, বরং বহু বিপন্নপ্রায় প্রজাতির বাসস্থান। দীর্ঘস্থায়ী অগ্নিকাণ্ডের কারণে এই গোটা বাস্তুতন্ত্রের প্রায় ৫৫ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ২০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পাশাপাশি, বিষাক্ত ধোঁয়াতেও প্রাণ হারিয়েছে বহু প্রাণী। শুধুমাত্র বড়ো প্রাণীদের ক্ষেত্রেই সেই সংখ্যা ২৯ হাজারের কাছাকাছি। সেইসঙ্গে কূপ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেলে ঢেকে রয়েছে জলাভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যা পুরোপুরি মুছে দিয়েছে মৃত্তিকাবাসী অণুজীবদের অস্তিত্ব। যারাই কিনা বাস্তুতন্ত্রের মূল ধারক। জীববৈচিত্রের এই শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়ার কারণেই পাখি, উভচর কিংবা জলজ প্রাণীদের ফিরে আসতেও সময় লেগে যাবে বছরের পর বছর।
তবে এই ক্ষতিকর প্রভাব যে শুধুই বাঘজানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়। মোটাপুং বিলের সঙ্গে আঞ্চলিক বিভিন্ন নদীর যোগাযোগ থাকায় রাসায়নিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে সেখানেও। ফলত, বিরল গাঙ্গেয় ডলফিনের বর্তমান সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র এক অঙ্কের সংখ্যায়। অন্যদিকে বিপর্যস্ত স্থানীয় মানুষও। মূলত মৎস্যশিকার, কৃষি এবং গবাধি পশুপালনের ওপরেই নির্ভরশীল তাঁরা। কিন্তু সে-জমি যে আর চাষযোগ্য নেই। দূষণের শিকার স্থানীয় জলাশয়গুলিও। ১৯৯১ সালের জনস্বার্থ বিমা এবং গ্রিন ট্রাইবুনালের যে ক্ষতিপূরণ, তা এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মেটাতে এককথায় অপ্রতুল।
আরও পড়ুন
হিরের খনির জন্য ২ লক্ষ বৃক্ষচ্ছেদনের পরিকল্পনা, দেশজুড়ে সরব পরিবেশকর্মীরা
তবে আশা হারাচ্ছেন না গবেষকরা। পরিকল্পনা মাফিক বৃক্ষরোপণ এবং পরিবেশ উদ্ধারের কর্মসূচি নিলে একদশক পরে কিছুটা হলেও প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য উদ্ধার করা যেতে পারে বলেই মনে করছেন তাঁরা। সেইসঙ্গে অসম সরকারকে দিয়ে রাখা হয়েছে সতর্কবার্তাও। বাঘজানের নিকটবর্তী তিনসুকিয়ায় আরও একটি তৈল খনির কথাও উল্লেখিত হয়েছে রিপোর্টে। গবেষকরা জানাচ্ছেন আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে সেখানেও ঘটে যেতে পারে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। তার আগেই যাতে দ্রুত সংরক্ষণ কর্মসূচি নেয় সরকার, সেই আবেদনই রাখছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন
আবারও আগুনের গ্রাসে আমাজন, ছাড়িয়ে যেতে পারে আগেকার বিপর্যয়ও
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী অগ্নিকাণ্ড, এখনও অনিশ্চিত বাঘজানের ভবিষ্যৎ