“ইউরোপ বা আমেরিকার দেশগুলিতে সমস্ত প্রাণীর সুন্দর ডেটাবেস আছে। আমাদের দেশে সেই ডেটাবেস খুবই অসম্পূর্ণ। আমাদের আশেপাশে যে সমস্ত প্রাণীদের দেখা যায়, তাদের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা তৈরি করাই আমাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্য।” বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সুমিত মণ্ডল। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি মেরিন ইকোলজি ল্যাবরেটরির গবেষকরা সুন্দরবনের ঠাকুরান নদীতে সন্ধান পেয়েছেন নতুন এক অঙ্গুরীমাল প্রাণীর। আর তার নামকরণেও জড়িয়ে নিয়েছেন সুন্দরবনকেই। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ ট্যাক্সোনমি’-তে।
সুন্দরবন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিস্তীর্ন ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রও অত্যন্ত জটিল। তার অনেকটাই হয়তো আজও আমাদের অজানা। তেমনই এক অজানা সদস্যের নাম রাখা হয়েছে সিগাম্ব্রা সুন্দরবনেনসিস। “আমরা মনে করেছি আন্তর্জাতিক ট্যাক্সোনমি ডেটাবেসে সুন্দরবনের নামটা তুলে আনার প্রয়োজন রয়েছে। এর আগে ভূগর্ভস্থ অঙ্গুরিমাল কোনো প্রাণীর নামকরণের সঙ্গে সুন্দরবনকে জড়িয়ে নেওয়া হয়নি।” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল। অন্যান্য অঙ্গুরীমাল প্রাণীর মতোই এটিও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাটির নিচে জমে থাকা পুষ্টিদ্রব্যকে তুলে আনে মাটির উপরে বায়োটার্বিউশন পদ্ধতির মাধ্যমে। এছাড়া এরা মাছ, কাঁকড়া প্রভৃতি প্রাণীর খাদ্য হিসাবেও ভূমিকা রাখে। সারা বিশ্বের একই গণভুক্ত বাকি ২৪টি প্রাণীর থেকে এদের শারীরবৃত্তীয় গঠন একেবারে আলাদা বলেই জানাচ্ছেন গবেষকরা। গবেষণায় প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক মণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর দুই স্কলার মৌমিতা ভৌমিক ও প্রিয়া ঘোষাল। এছাড়া মেক্সিকো থেকে বিজ্ঞানী ডঃ সেরগিও সালাজার যুক্ত ছিলেন গবেষণায়। ইতিমধ্যে ‘গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ইনফর্মেশন ফেসিলিটি’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার অফ মেরিন স্পিসিস’ নামের দুটি আন্তর্জাতিক ডেটাবেসে নতুন এই প্রাণীর নাম সংযুক্তও হয়েছে।
শুধুই এই একটি প্রাণী নয়, বছর দেড়েক আগে মাতলা নদী থেকেও অনুরূপ একটি অঙ্গুরিমাল প্রাণী আবিষ্কার করেছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ল্যাবরেটরির গবেষকরা । তার নাম দেওয়া হয়েছে অ্যান্সিওস্টিলিস মাতলাএনসিস। বিগত দশকটিকে ইউএন-এর পক্ষ থেকে বিশ্ব জীববৈচিত্র দশক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের আশেপাশের পরিবেশের জীববৈচিত্রকে বুঝতে চেয়েছেন গবেষকরা। সুন্দরবন অঞ্চলে মোট ৫৬ টি অঙ্গুরিমাল প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা। তার মধ্যে এই দুটি বিজ্ঞানীদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন প্রাণী।
আরও পড়ুন
পোষ্য প্রাণীদের দূরে সরিয়ে দেবেন না, আগলে রাখুন মহামারীতেও
ডঃ সুমিত মণ্ডল বলছিলেন, “আমরা যদি আমাদের বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটা সদস্যকে না চিনি, তাহলে আগামীদিনে বাইরের বাস্তুতন্ত্র থেকে কোনো প্রাণী ঢুকে পড়লে অর্থাৎ বায়ো-ইনভেশন ঘটলেও বুঝতে পারব না। আবার হয়তো শণাক্ত করার আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে অনেক প্রাণী।” জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তো রোজ একটু একটু করে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নানা বন্য প্রাণী। মানুষের স্বার্থেই তাদের বাঁচিয়ে রাখা আজ ভীষণ জরুরি। “চলমান করোনা অতিমারী তো সামান্য একটা উদাহরণ। বন্যপ্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এর থেকেও ভয়ানক মহামারীর কবলে পড়তে পারে মানুষের সভ্যতা।” সতর্ক করে দিয়ে অধ্যাপক মণ্ডল বললেন, “এর জন্য সবার আগে সমস্ত প্রাণীদের চিনতে হবে এবং বাস্তুতন্ত্রে তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে জানতে হবে।”
আরও পড়ুন
উটেদের জন্য ট্রাফিক সিগন্যাল, প্রাণী সুরক্ষায় পথ দেখাচ্ছে চিন
আরও পড়ুন
বিগত ১০ বছরে ভারতে হিংস্রতার শিকার ৫ লক্ষ প্রাণী
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে বাঁচিয়ে রাখার কথা সাম্প্রতিক সময়ে উঠে এসেছে বারবার। “সুন্দরবন না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে কলকাতাও বাসযোগ্য থাকবে না। সেটা আমরা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছি।” বলছিলেন অধ্যাপক মণ্ডল। আর সুন্দরবন মানে তো শুধুই ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ নয়। বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ছোটবড়ো নানা জীব। তাদের সবাইকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর তার জন্য চাই উপযুক্ত ধারণা। তাই চলমান দশকটি আইইউসিএন-এর পক্ষ থেকে ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। অধ্যাপক মণ্ডলের কথায় “আজকাল আমাদের দেশে পড়ুয়া, গবেষকরা পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্র নিয়ে গবেষণায় তো তেমন আগ্রহী নয়। আমরা এই গবেষণার ভিতর দিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহটাও বাড়িয়ে দিতে চাইছি। আরও আরও পড়ুয়ারা এগিয়ে আসুক প্রাণীদের শণাক্ত করার কাজে। সেটাই কাম্য।” আমাদের জীববৈচিত্রের কতটুকুই বা চিনি? নতুন নতুন গবেষণায় সেই চিত্রটাই আরও পরিষ্কার হয়ে উঠুক।
Powered by Froala Editor