আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগেকার কথা। চিনের হেইলংজিয়াং প্রদেশে সঙ্গুয়া নদীর ওপরে সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। অবশ্য গোটা অঞ্চলটাই তখন জাপানের অধীনে। সেই নির্মাণকার্যের সময়েই নদী তীরবর্তী অঞ্চলে একটি প্রাচীন মানবখুলির সন্ধান পান স্থানীয় এক চৈনিক শ্রমিক। খুলিটির ঐতিহাসিক মূল্য যে অনেক, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। ফলত, জাপানি শাসকদের চোখ এড়িয়েই তিনি সেটিকে নিয়ে চলে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে। লুকিয়ে রেখেছিলেন কুয়োর ভিতরে। সেখানেই প্রায় দীর্ঘ ৮০ বছর সংরক্ষিত ছিল প্রাচীন মানব খুলিটি। মৃত্যুর আগে ওই ব্যক্তি খুলিটির অস্তিত্বের সম্পর্কে জানান তাঁর পরিবারকে। পরবর্তীতে তাঁদের হাত ধরেই সেই খুলি এসে পৌঁছায় চিনের হেবেই জিও বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সম্প্রতি, সেই প্রাচীন খুলি থেকেই খুলে গেল বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নতুন দরজা। না, যে-সে খুলি নয়; বরং সম্পূর্ণ অজানা এক মানব প্রজাতির খুলি হিসাবেই সেটিকে চিহ্নিত করছেন গবেষকরা। সদ্য-আবিষ্কৃত প্রাগৈতিহাসিক এই মানব জনগোষ্ঠীর নামকরণ করা হয়েছে হোমো লঙ্গি। চিনা ‘লঙ্গি’ শব্দটির অর্থ ড্রাগন। অর্থাৎ, সহজ ভাষায় ‘ড্রাগন ম্যান’ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে প্রাচীন খুলিটিকে।
গবেষকদের অনুমান, আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে বসবাস করত এই বিশেষ মানবগোষ্ঠী। মূলত পূর্ব এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিল তাদের বিচরণক্ষেত্র। তবে উত্তর-পূর্ব চিনের হারবিন শহরে এই খুলি পাওয়া গেলেও, ওই অঞ্চলেই ড্রাগনম্যানের বসবাস ছিল কিনা, তা এখনও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না গবেষকরা। কারণ, খুলি ছাড়া প্রাচীন এই মানবগোষ্ঠী ব্যবহৃত কোনোরকম প্রস্তরজাত অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রীরই হদিশ পাওয়া যায়নি। ফলত, অন্য কোনো অঞ্চল থেকে নদীবাহিত হয়ে খুলিটি হারবিনে পৌঁছেছিল, থেকে যাচ্ছে সেই সম্ভাবনা।
এতদিন পর্যন্ত মনে করা হত, আধুনিক মানুষ বা হোমো সাপিয়েন্সের সঙ্গে সবথেকে বেশি মিল রয়েছে নিয়ান্ডারথ্যাল প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর। এবং নিয়ান্ডারথ্যালেরই একটি শাখা থেকে বিবর্তিত হয়ে জন্ম নিয়েছিল আধুনিক মানুষ। তবে এই তত্ত্বও এবার বদলে যেতে পারে সাম্প্রতিক আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে। কারণ, জিনগত গবেষণা এবং খুলির গঠন— উভয়ই ইঙ্গিত দিচ্ছে নিয়ান্ডারথ্যালের থেকেও হোমো সেপিয়েন্সের সঙ্গে বেশি মিল রয়েছে ড্রাগন ম্যানের। ফলত, বিগত এক হাজার বছরে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধানের মধ্যে এটিকে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসাবেই চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এই আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করেই আগামীতে নতুন করে লেখা হতে পারে মানব-বিবর্তনের ইতিহাস।
আরও পড়ুন
আন্টার্কটিকায় নতুন উদ্ভিদ প্রজাতি আবিষ্কার ভারতীয় গবেষকের
বিগত ২৫ জুন এই পরীক্ষামূলকভাবে নতুন এই মানব প্রজাতির আবিষ্কারে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংবাদ ঘোষণা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি, বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকা ‘জার্নাল অফ ইনোভেশন’-এ প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাটি। আশ্চর্যের বিষয় হল, চারিত্রিক দিক থেকে প্রাগৈতিহাসিক অন্যান্য মানবগোষ্ঠীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল ড্রাগনম্যান। তাদের শারীরিক গঠন ছিল অনেক মজবুত। সাধারণ খুলির থেকে অনেকটাই বড়ো ছিল তাদের খুলি এবং চতুর্ভূজাকৃতির অক্ষিকোটরের আয়তন। ছিল প্রশস্ত মুখ এবং বড়ো আকারের দাঁত। তবে খুলি আয়তনে বড়ো হলেও, মূল মস্তিষ্ক ছিল বর্তমান মানুষের মস্তিষ্কের সমানায়তনের।
আরও পড়ুন
যুদ্ধ, মহামারী, অভিবাসনে অশান্ত গোটা বিশ্ব; ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে মানব সভ্যতা?
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও চিনের দালি, হুয়ালংডং, তিব্বত, জিন্নিওশান প্রভৃতি অঞ্চলে একাধিক মানব প্রজাতির কঙ্কাল এবং খুলির সন্ধান পেয়েছিলেন গবেষকরা। তবে পরবর্তীতে সেই দেহাংশগুলিকে ডোনিসোভান্স প্রজাতির মানবগোষ্ঠীর অবশিষ্টাংশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে সাম্প্রতিক আবিষ্কার নিরাশ করল না বিজ্ঞানীদের। বরং, নতুন করে দরজা খুলে দিল এক অজানা পৃথিবীর।
আরও পড়ুন
জরায়ু নয়, গবেষণাগারেই তৈরি হল মানবভ্রুণ, ইতিহাসে প্রথম
Powered by Froala Editor