যতদূর দেখা যায় শুধু বালি আর বালি। মাঝেমধ্যে ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে কাঁটাগুল্মের ঝোপ। দূরে শুকনো পাথুরে পাহাড়। আর এই শুনশান মরুভূমির বুক চিরে গিয়ে গেছে এগিয়ে গেছে দীর্ঘ রাস্তা। না, মানুষের বাস নেই এই অঞ্চলে। নেই কোনো গণপরিবহন পরিষেবা। তবে এই পথ ধরে যেতে গেলেই যাত্রীদের চোখে পড়তে বাধ্য এক অদ্ভুত দৃশ্য। এই শুনশান মরুপ্রান্তরে, যেখানে মানুষ বাস নেই, সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি রংবাহারি পাথুরে স্তম্ভ। রৌদ্রের আলোয় ঝলমল করছে তাদের এবড়োখেবড়ো চেহারা।
লাস ভেগাস বলতেই মানুষের চোখে ভেসে ওঠে সারা রাত জেগে থাকা একটা শহরের ছবি। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অট্টালিকা, বার, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো। তবে সানসিটির পরিধি ছাড়িয়ে মাইল দশেক দূরে গেলেই শুরু হয়ে যাবে নেভাডার বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তর। এতক্ষণ কথা হচ্ছিল সেই মরুভূমি নিয়েই। লাস ভেগাসের অদূরে অবস্থিত মরুভূমিতেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আশ্চর্য সেই স্তম্ভগুলি।
‘সেভেন ম্যাজিক মাউন্টেনস’ (Seven Magic Mountains)। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত আমেরিকার মরুপ্রান্তরে অবস্থিত এই আশ্চর্য পাথুরে টোটেমগুলি। নাম থেকেই ধারণা পাওয়া যায় আদতে সবমিলিয়ে ৭টি এধরনের স্তম্ভ রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। বিগত কয়েক বছরে উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে যাদের জনপ্রিয়তা। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা তো বটেই, বর্তমানে এই আশ্চর্য স্থাপত্য দেখতে শুনশান মরুভূমিতে হাজির হন বিদেশের পর্যটকরা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই আশ্চর্য স্তম্ভগুলির নির্মাতা কে? কবেই বা তৈরি হয়েছিল এই স্তম্ভগুলি?
সেই গল্পেই যাওয়া যাক বরং। ২০১৪ সালের কথা। মরুভূমির বুকে একটি ভিন্নধরনের ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা করে ‘নেভাদা মিউজিয়াম অফ আর্ট’। কিন্তু কেমন হবে সেই ভাস্কর্য? এই আশ্চর্য শিল্পসৃষ্টির ভার দেওয়া হয় সুইস শিল্পী উগো রন্ডিনোনেকে। উগোর জন্ম সুইজারল্যান্ডে হলেও, তিনি যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী। ‘সেভেন ম্যাজিক মাউন্টেন’-এর নকশা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর কথায়, এই সাতটি স্তম্ভ আসলে বিশ্বের সাতটি মহাদেশের প্রতীক। পাশাপাশি শুনশান মরু অঞ্চলে এই স্তম্ভগুলি প্রকৃতি ও সভ্যতার মধ্যস্থতাকে প্রতিফলিত অরে।
এই ভাস্কর্য তৈরির জন্য লাস ভেগাস বোলেভার্ডের ৫ মাইল উত্তরে আই-১৫ হাইরোডের ঠিক ধারের একটি ফাঁকা অঞ্চলকে বেছে নিয়েছিলেন উগো। ‘নেভাদা মিউজিয়াম অফ আর্ট’ ছাড়াও এই ভাস্কর্য তৈরিতে অর্থায়ন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘আর্ট প্রোডাকশন ফান্ড’। ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এই কর্মযজ্ঞ। গোটা স্থাপত্যটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর। তবে মোটেও সহজ ছিল না এই কাজ।
প্রথমত, নেভাডার এই শুনশান মরুপ্রান্তরে দিনের বেলায় গড় তাপমাত্রা থাকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। প্রখর রৌদ্রে কয়েক মুহূর্তের জন্য ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার উপায়ও নেই কোনো। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থাও। সেইসঙ্গে মরুভূমির মধ্যে ঘুরে বেড়ায় ঘাতক র্যাটেল স্নেক। সবমিলিয়ে এই ভাস্কর্য নির্মাণ তাঁর জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল বলেই দাবি করেন সুইস শিল্পী।
মজার বিষয় হল, এই স্তম্ভগুলি নির্মাণে ব্যবহৃত সমস্ত পাথরই সংগ্রহ করে হয়েছিল মরুভূমি থেকে। মরুভূমি ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক বোল্ডার ও শিলাখণ্ড সংগ্রহ করে সেগুলি কেটে ছোটো করা হয় প্রথমে। তারপর একে একে সেগুলিকে পর পর সাজিয়ে গড়ে তোলা হয় স্তম্ভগুলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ভূমিকম্পে যাতে ৩০ ফুট উচ্চতার এই স্তম্ভ ভেঙে না পড়ে, তার জন্যেও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। পাথরগুলির কেন্দ্রে ড্রিল করে মাটির সঙ্গে গেঁথে রাখা হয়েছে দীর্ঘ লোহার স্তম্ভ। যা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
২০১৬ সালে নির্মাণ শেষ হয় এই আশ্চর্য ভাস্কর্যের। মজার বিষয় হল, সে-সময় নেভাডা প্রশাসন ঠিক করেছিল এই বিশেষ শিল্পকর্মটি প্রদর্শিত হবে মাত্র ২ বছরের জন্য। তারপর তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে ভিন্ন জায়গায়। তবে ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকার কারণে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যুরো অফ ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ আরও ৩ বছর বাড়িয়ে দেয় এই প্রদর্শনীর সময়সীমা। তবে ২০২১ সালে সেই পারমিট শেষ হয়ে গেলেও, ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার জন্য কোনোরকম বিশেষ আইন প্রণয়ন করেনি নেভাডা প্রশাসন। আজও তা দিব্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে মরুভূমির বুকে। বলতে গেলে, ‘সেভেন ম্যাজিক মাউন্টেন’ নিয়ে মার্কিনিদের মনোভাব অনেকটা যেন চন্দ্রবিন্দুর সেই গানটির মতোই, ‘এই এবড়োখেবড়ো রং থাক বরং’…
Powered by Froala Editor