একেবারে প্রত্যাশামতো নেটফ্লিক্সে ‘রে’ নামের সিরিজটি মুক্তি পাওয়া মাত্রে শিক্ষিত বাঙালি সমাজে একটা হইহই পড়ে গেছে। চারটি ছবি। সত্যজিতের চারটি গল্প অবলম্বনে। যে চারটে গল্পকে বেছে নেওয়া হয়েছে তারা সত্যজিতের সেরা বারোর মধ্যে আসবে না। এটা আরও কিছুটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে, কারণ সত্যজিৎ নিজে তাঁর মতে নিজের লেখা সেরা গল্পগুলো অনুবাদ করেছিলেন বিলাতি প্রকাশনা স্যাকার এন্ড ওয়ারবার্গের জন্য। তার মধ্যে এঁর একটা গল্পও নেই। চারটি গল্পকে বাছা হয়েছে, সেখান থেকে নির্যাস নেওয়া হয়েছে, তারপর চিত্রনাট্যকার আর পরিচালক মিলে সত্যজিতের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত বলে ছবিগুলো বানিয়েছেন। সেগুলো শিল্পগতভাবে মানে উত্তীর্ণ কিনা সে আলোচনা দূরস্থান, মূল আলোচনা চলছে এই ‘অনুপ্রেরণা’ বা অ্যাডাপটেসান অংশ নিয়ে। একটি ছবিতেও মূল কাহিনিকে অনুসরণ করা হয়নি। সবার আপত্তির জায়গা সেটাই। আর তাই এই বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
সাহিত্য আর সিনেমার ভাষা আলাদা। এটা বলতে বলতে প্রায় ক্লিশে হয়ে গেছে। রাম রোজ বনে ফুল তুলতে যায়, এটা লেখা যতটা সহজ, দেখাতে গেলে রোজ একটা লোককে দিয়ে ফুল তোলানো সম্ভব না। সেখানে হয়তো একটা বাড়তি চরিত্র আমদানি করতে হবে যে রামকে জিজ্ঞেস করবে “কীরে? কোথায়? বনে ফুল তুলতে?” রাম হেসে জবাব দেবে, “হ্যাঁ, ওই রোজ যেমন যাই।” ব্যাস হয়ে গেল। সাহিত্যের পাঠক এখানে বাড়তি চরিত্র নিয়ে হা হুতাশ করলে মুশকিল। এবার পরিচালক যদি ভাবেন বনে রোজ ফুল তুলতে যাওয়াটা নেহাত পানসে, আনসিনেম্যাটিক, তিনি এখানেও ছোট্ট করে একটা সাসপেন্স যোগ করতে পারেন। রামের ফুলের ঝুড়িতে ক্যামেরা জুম করে, দেখা যায় একটা ছুরি। তাতে লাল কিছু লেগে আছে। এবার সেই লাল ছুরি আলতা মাখা কিনা, রাম তা দিয়ে গাছের ডাল কাটে কিনা, নাকি রাম কাউকে খুন করে বনে ছুরি লুকাতে যাচ্ছে, তা দর্শক ভাবুন না। এখানে সচেতনভাবে পরিচালক সাহিত্য থেকে সরলেন। আর এই জুম করে ছুরি দেখানোর সুযোগ আছে বলেই সরলেন। সাহিত্যে এ-জিনিস করা অসম্ভব।
সাহিত্যের মূল কাহিনি থেকে না সরেও কীভাবে সিনেম্যাটিক আবহাওয়া তৈরি করতে হয়, তাঁর হদিশ হিচকক দিয়ে গেছেন। গল্পে লেখা আছে দুইজন মানুষ হোটেলে বসে আলোচনা করছে। তিনি অবিকল দৃশ্যটা রাখলেন, শুধু প্রথম দৃশ্যে দেখিয়ে দেওয়া হল টেবিলের নিচে কেউ একটা টাইম বোম রেখে গেছে, যার কাঁটাটা টিকটিক করছে। এবার লোকদুটি একেবারে নির্দোষ আলোচনা করছে, তাঁর দর্শক উৎকণ্ঠায় আঙুল কামড়াচ্ছেন। মাঝেমাঝেই বোমটাকে দেখানো হচ্ছে। আর মাত্র কয়েক মিনিট। দর্শক পারলে লোকদুটোকে ডেকে বলেন, উঠুন মশাই, নিচে বোম আছে। শেষে যে বোম ফাটবেই তাঁর মানে নেই। হতেই পারে তারা দুজন বেরোনো মাত্র বোমা ফাটল। কাহিনিতে চোট লাগল না। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সাহিত্যে যেটা একেবারেই নীরস এক কথোপকথন ছিল, পরিচালক সিনেমার ভাষা দিয়ে তাঁকে নতুন মাত্রা দিলেন।
সিনেমায় অনুপ্রেরণায় বেলায় সেটাই মূলত হয়। বিশ্ব সিনেমায় বহুবার এই অনুপ্রেরোনায় অসামান্য সব ছবি তৈরি হয়েছে, যারা মূল সাহিত্য থেকে বেশ দূরে। রিওনসুকে আকুতাগাওয়ার দুটো গল্পের নির্যাস নিয়ে নিজের মতো তাঁকে সাজিয়ে কুরোসাওয়া যখন তাঁকে সিনেমায় রূপ দিলেন, তখন মূল কাহিনির সহজ সরল ন্যারেটিভ পুরো বদলে গেল। জন্ম নিল সিনেমার এক নতুন ভাষা। একই ঘটনার মালটিপল ন্যারেটিভ, যাতে প্রত্যেক বক্তার সঙ্গে গল্পও বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই ‘রশোমন এফেক্ট’ তৈরিই হত না, যদি কুরোসাওয়া মূল সাহিত্যের ন্যারেটিভে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন।
১৯৫০ এর দশকে ফ্রাসোঁয়া ত্রুফো সিনেমায় যে ‘অতর থিয়োরি’ আনেন তাতে সাহিত্যের মূল ভাবের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছিল চিত্রনাট্যের জোর। সত্যজিৎ নিজেও একজন ‘অতর’ ছিলেন, ফলে তাঁর ছবিতেও সেই সাহিত্য ভাঙা সবল চিত্রনাট্যকে প্রথমবার দেখতে পাই। ভারতীয় ছবির একটা সমস্যা চিরকাল ছিল। ভারতের প্রথম সিনেমা রাজা হরিশচন্দ্র। এবং যতদিন না ‘বিলাত ফেরত’ এঁর মতো সিনেমা এসেছে, ততদিন ভারতীয়রা চেনা গল্পকে পর্দায় চেনাভাবে দেখে এসেছে। কালীয় দমনে কে কবে কোথায় কী করবে সব জেনেও হল ভরিয়েছে দিনের পর দিন। ভারতীয় দর্শক আর চিত্র সমালোচকদের মধ্যে তাই বইয়ের চলতাফিরতারূপকে সিনেমা হলে দেখার একটা প্রবণতা চিরকালই ছিল। সত্যজিৎ নিজেও লিখেছেন “উপন্যাস বা ছোটগল্পকে চিত্ররূপ দিতে হলে শিল্পের খাতিরে যে পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তা বহুকাল থেকেই বিদেশে স্বীকৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সমালোচক আজও এই পরিবর্তনের শিল্পগত প্রয়োজনটা মেনে নিতে পারেননি। অপু কাহিনিত্রয় বা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের চিত্ররূপ দেবার পর আমাকে তাই প্রতিবারই সমালোচকের বিস্তারিৎ তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে এবং প্রতিবারই মনে হয়েছে চোখের সামনে চিত্ররূপ এবং হাতের সামনে মূল গল্পটি থাকার দরুণ দুই-এর বৈসাদৃশ্যের সহজ ফিরিস্তি দিয়ে সমালোচক তাঁর মূল দায়িত্বটুকু সম্পূর্ণ এড়িয়ে কতকগুলি অপ্রাসঙ্গিক, আপাতসারগর্ভ কথার সাহায্যে কলাম ভরানোর কাজটি সেরে নিচ্ছেন।” এটা তাঁর পক্ষে বলা অস্বাভাবিক না, কারণ সমাপ্তির শেষ দৃশ্যে মায়ের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেওয়া, কিংবা চারুলতায় রবীন্দ্রনাথের মূল সুরটি না ধরতে পারার জন্য অচলপত্র, পরিচয় সহ একাধিক পত্রিকা তাঁর উপরে খড়গহস্ত হয়। তিনিও অবশ্য ছেড়ে না দিয়ে বেশ দুকথা শুনিয়েও দিয়েছিলেন। সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কথা হল সাহিত্য থেকে ছবি বানাতে গেলে তাঁর আদর্শ ঠিক কী হবে?
সত্যি বলতে কী, সঠিক উত্তর, বা ম্যাজিক ঠিক কোথায় হবে কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত কবিতার মতো সেসব উপন্যাসে ঘটনার ঘনঘটার তুলনায় ভাষা আর আবেগ এগিয়ে আছে, সেখান থেকে সরাসরি ছবি করলে তা বাজে হতে বাধ্য। ঠিক যে কারণে মার্কেজের একটি উপন্যাস থেকেও ভাল ছবি হয়নি। বা বিভূতিভূষণের আরণ্যক বা দেবযান নিয়ে ছবির কথা ভাবেন না কেউ। পাশাপাশি মূল উপন্যাস থেকে কিছুটা সরে এসেও সাহিত্য ছাপানো সিনেমা যে করা যায় তাঁর উদাহরণ লর্ড অফ দ্য রিংস ট্রিলজি অথবা দ্য গডফাদারের বিশেষ করে দ্বিতীয় ভাগ। অনেকসময় আবার মূল সাহিত্য থেকে সরে আসা ব্যাকফায়ার করে। দ্য ম্যাল্টিজ ফ্যালকন ছবিটা বোগার্ট করার আগে দুইবার তথাকথিত সিনেম্যাটিক ভাবে বদলে দেওয়া হয়েছিল। একবার ডেঞ্জারাস ফিমেল অন্যবার স্যাটান মেট এ লেডি নামে। দুইবারই চূড়ান্ত ফ্লপ। শেষে মূল কাহিনি ধরে সিনেমা বানাতেই ইতিহাস তৈরি হল। ঠিক যেমনটা করেছিলেন কোয়েন ভাইরা। করম্যাক ম্যাকার্থির নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান-কে প্রায় ছত্রে ছত্রে, লাইনে লাইনে ধরেছে এই ছবি। কারণ কাহিনিতেই সেই নাটকীয়তা ছিল। আবার পল থমাস অ্যান্ডারসন যখন আপটন সিনক্লেয়ারের উপন্যাস 'অয়েল' থেকে দেয়ার উইল বি ব্লাড বানালেন, তখন মূলের সঙ্গে মিল প্রায় নেই বললেই চলে। এদিকে দুটোই অস্কার পাওয়া অসামান্য ছবি। আসলে এই ব্যালেন্সটা পরিচালক বোঝেন। সত্যজিৎ নিজেও বলে গেছেন “ছবির কোন দোষ বা গুণের জন্য কাকে কতখানি দায়ী করা চলতে পারে, তা জানেন একমাত্র তাঁরাই যারা ছবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সংশ্লিষ্ট। সমালোচকের পক্ষে তাই নিন্দা প্রশংসার ভাগ বাটোয়ারার ব্যাপারটা ভারী বিপজ্জনক। এবং পরিচালকের দৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়।”
তাহলে এই অনুপ্রেরণার দিশা ঠিক কেমন হবে? কবি রবার্ট ফ্রস্ট কবিতার অনুবাদের ঘোর বিপক্ষে ছিলেন। বলতেন অনুবাদে কবিতা হারিয়ে যায়। সিনেমার বেলাতেও অনেকে বলেন, সিনেমায় নাকি মূল সাহিত্য হারিয়ে যায়। এটা তাঁরাই বলেন যারা সিনেমায় মূল সাহিত্য খুঁজতে আসেন। পরিচালক বা চিত্রনাট্যকাররা স্কুলের মাস্টারমশাই নন, কিংবা দোভাষী নন যে সাহিত্যর ভাষাকে হুবহু পর্দায় দেখাবেন। দেখাতেই পারেন, কিন্তু নাও পারেন। সফল সিনেমা সাহিত্য থেকে তখনই হতে পারে, যখন চিত্রনাট্যকার বা পরিচালক সাহিত্য এবং সিনেমা, দুটো আলাদা মাধ্যমের ভাষাই আন্তরিকভাবে রপ্ত করতে পারেন। তারপর সাহিত্যের ভাষাকে তোতাপাখির মতো পর্দায় না আউড়ে তাঁকে আত্মার অংশ করে, নিজের মধ্যে জারিত করে, সম্পূর্ণ নতুন আলোতে, নতুন ভাবে পর্দায় নিয়ে আসেন। সফল অনুপ্রেরণা সেটাই যেটা স্বাধীন। মুক্ত। এই চেতনা বিশ্বের প্রতিটি বড়ো পরিচালকের ছিল, আছে। কুব্রিক থেকে সত্যজিৎ, হিচকক থেকে ওয়াইল্ডার সবাই তাই দিনের শেষে সাহিত্যকে বেছে নিয়েছেন আশ্রয় হিসেবে। সেখান থেকে আইডিয়া নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রয়োগ করেছেন নিজের মতো। পাঠকের সন্দেহ থাকলে আমি দ্য সাইনিং, জন অরণ্য, সাইকো আর ডবল ইনডেমিনিটি উপন্যাসগুলো পড়ে তারপর ছবি দেখতে অনুরোধ করছি। একটা সাহিত্য কীভাবে নিজেকে বদলে সিনেমায় পরিণত হতে পারে তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ এগুলো। ঠিক এঁর পাশেই দ্য গোল্ডফিঞ্চ দেখুন, সিনেমায় সাহিত্য অনুসরণ করতে গিয়ে কী দারুণ ডুবিয়েছে।
২০২০ সাল থেকে মানবসভ্যতায় এক নতুন যুগের শুরু হল। হয়ত নতুন না, চিরকালই ছিল, কিন্তু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এই প্রথম। দ্রুত অভিযোজনের যুগ। চারিদিকের পরিবেশ মাত্র এই অল্প সময়ে এত বদলাতে একশো বছরে কেউ দেখেনি। আর সেখানেই যারা এই নতুন পরিবেশে মানাতে পারছে না, হারিয়ে যাচ্ছে। সঠিক অ্যাডাপটেসন তাই একমাত্র চাবিকাঠি। সে জীবনে হোক, অথবা সিনেমায়। এ ছাড়া গতি নেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor