বিশ্বের ১৪টি শৃঙ্গজয়ী নির্মলকে নিয়ে সিনেমা, হার-না-মানা জেদের ঝলক পর্দাতেও

‘হার মানা আমাদের রক্তে নেই।’ ট্রেলারের শেষে এই কথাটিই বুঝিয়ে দিয়েছিল নিছক একটি পর্বতারোহণের ডকুমেন্ট্রির চেয়ে বেশি কিছু বলতে চলেছে সিনেমাটি। ট্রেলারেই শোনা গিয়েছিল, যদি পশ্চিমের কোনো পর্বতারোহী এমন কাজ করতেন, তাহলে বিশ্বজুড়ে হইহই পড়ে যেত। হইহই পড়ে যাওয়ার মতোই কাণ্ড ঘটিয়েছেন নেপালের পর্বতারোহী নির্মল পুরজা (Nirmal Purja) এবং তাঁর দলের বাকি শেরপারা। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ১৪টি শৃঙ্গ, যাদের প্রত্যেকের উচ্চতা ৮ হাজার মিটারের চেয়ে বেশি – মাত্র ৭ মাসের মধ্যে সেই সমস্ত শৃঙ্গ জয় করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন পুরজা। পরিকল্পনা শুনে হাসাহাসি করেছিলেন অনেকেই। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তব হল। আর সেই কাহিনি নিয়েই সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেল ‘১৪ পিকস : নাথিং ইজ ইম্পসিবল।’

নেপাল, তিব্বত, ভারত, পাকিস্তান এবং চিনের পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ১৪টি শৃঙ্গ, যাদের উচ্চতা ৮ হাজার মিটারের চেয়েও বেশি। এখনও অবধি খুব কম পর্বতারোহীই এই সমস্ত শৃঙ্গ জয় করেছেন। ১৯৮৬ সালে ইতালির পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনার প্রথম ১৪টি শৃঙ্গ জয় করেছিলেন। তবে তাঁর অভিযান শেষ হতে সময় লেগেছিল ১৬ বছর। পুরজার আগে পর্যন্ত ৭ বছরে সমস্ত শৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড ছিল। পুরজা সেই রেকর্ড ভাঙতে চেয়েছিলেন। শুধু রেকর্ড ভাঙতেই নয়, মাত্র ৭ মাসে ১৪টি শৃঙ্গ জয় করতে চেয়েছিলেন। সবাই এক কথায় বলেছিলেন, এই পরিকল্পনা অসম্ভব। কিন্তু পৃথিবীতে কোনোকিছুই যে অসম্ভব নয়, সে-কথাই প্রমাণ করেছিলেন পুরজা। ২০১৯ সালের এক দুঃসাহসিক অভিযানে মাত্র ৬ মাস ৬ দিনের মধ্যে ১৪টি শৃঙ্গ জয় করলেন তিনি এবং অবশ্যই তাঁর সহযোগী শেরপারা।

সিনেমাটির শেষে এই যৌথতার বার্তাই দিতে চেয়েছেন পুরজা। বলেছেন, এই সাফল্য তাঁর একার নয়। শেরপাদের ছাড়া তিনি সফল হতে পারতেন না। আর কেবল শেরপা বলে তাঁদের পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তাঁদেরও নাম আছে। তাঁরাও এক একজন পর্বতারোহী। এরপর একে একে দলের সমস্ত সদস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। হিমালয়ের যে কোনো শৃঙ্গজয়ের সময়েই পর্বতারোহীদের সঙ্গে থাকেন একদল শেরপা। অথচ অভিযানের শেষে তাঁদের নামের উল্লেখও থাকে না কোথাও। মূলত নেপাল থেকে আসা এই শেরপারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কাজ করে চলেছেন কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই। পাশ্চাত্য পর্বতারোহীদের নাম প্রচারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই জাতিগত বঞ্চনার মূলেই আঘাত করেছেন পুরজা। আর তাই তিনি বলেছেন, ‘হার মানা আমাদের রক্তে নেই।’ না, শেরপারা হার মানেন না।

কখনও হিমেল বাতাস বয়েছে ঘণ্টায় ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে। কখনও আবার চোখের সামনে ধস নেমেছে। নরম বরফে পা পিছলে প্রায় ১০০ মিটার নিচে পড়ে গিয়েছেন পুরজা। আবার উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন। সমস্ত বিদ্রূপের উত্তর দিতে গেলে যে তাঁকে সফল হতেই হবে। এমনই সব গায়ে কাঁটা দেওয়া দৃশ্য নিয়ে তৈরি ডকুমেন্ট্রিটি। পর্বতারোহীরাই অভিযানের সময় সেইসব ফুটেজ তুলে এনেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ঘণ্টার ফুটেজ তুলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তা দিয়ে কীভাবে সিনেমা তৈরি করতে হয়, তা যে তাঁরা জানেন না। শেষ পর্যন্ত লন্ডনে পৌঁছে পরিচালকের টারকুইল জোনসের সাহায্য পেলেন পুরজা। মাত্র ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিটের একটি সিনেমায় ১৪টি শৃঙ্গজয়ের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলাও সহজ ছিল না। কিন্তু জোনসের নির্দেশনায় শেষ পর্যন্ত সেটাও সম্ভব হয়। আর সিনেমাটি তৈরি পর জোনসই তা নিয়ে যান নেটফ্লিক্সের দপ্তরে। বিষয়বস্তু শুনেই এক কথায় রাজি হয়ে যান তাঁরা। অবশেষে ২৯ নভেম্বর মুক্তি পেল ‘১৪ পিকস : নাথিং ইজ ইম্পসিবল’। ২০১৯ সালের অভিযানের শেষেও তেমন স্বীকৃতি পাননি পুরজা। তবে এবার এই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই হইহই পড়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন
শুধু ‘মন্দার’-ই নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে একাধিকবার ছায়া ফেলেছে ম্যাকবেথ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাংলার 'প্রথম' চলচ্চিত্র সমালোচক তিনি, চিদানন্দ দাশগুপ্তকে কতটা মনে রেখেছে বাঙালি?

More From Author See More