চতুর্থ পর্ব
জয় যুক্তেষু,
দেশ বিভাগের পর আমি স্থির করিয়াছি, দেশ পরিত্যাগ করিব না। পূর্ব পাকিস্তানেই থাকিব। আমি পূর্ব পাকিস্তানেই আছি।
ব্রহ্মদেশের মান্দালয় জেলে যাহার সহিত একত্র গিয়াছিলাম। জেলে প্রবেশ করার পর যিনি বলিয়াছিলেন ‘মহারাজের সিট আমার পাশে থাকিবে’, আমি যাহার পাশে ছিলাম, একসঙ্গে টেনিস খেলিয়াছি, দুর্গাপূজার জন্য অনশন ধর্মঘট করিয়াছি – আমি তাহার কথা ভুলি নাই, তাহার সঙ্গেই আছি।
দিল্লিতে ১৯৪০ সনে, শঙ্করলালের বাড়িতে যাহার সহিত একত্র ছিলাম, মোটরে ইউ পি ভ্রমণের সময় যাহার পাশে ছিলাম, প্রচণ্ড শীতের রাত্রে আগরার মাঠে রাত্রি ৯টা পর্যন্ত বহু সহস্র লোক যাহার প্রতীক্ষায় ছিল – আমি সাগ্রহে তাহারই প্রতীক্ষায় আছি। পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিন, নিপীড়িত জনগণ তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া আছে।
শ্রীত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী
গুমনামী বাবার মৃত্যুর পর, তাঁর ঘর থেকে পাওয়া অসংখ্য চিঠির মধ্যে থেকে পাওয়া গিয়েছিল এই চিঠিটিও। ১৯৬৩ সালের এপ্রিলে লেখা। প্রসঙ্গত, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ছিলেন একজন উল্লেখযোগ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দীর্ঘ ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। কিন্তু এই চিঠি গুমনামী বাবাকে কেন লিখতে গেলেন তিনি?
তৃতীয় পর্ব
'মৃত' নেতাজির যে ছবিগুলি দেখে চমকে উঠেছিল বাঙালি
গত দু-তিনটি নেতাজির মৃত্যু-সংক্রান্ত যত আলোচনা হয়েছে, তার সিংহভাগ জুড়েই আছে একটি প্রশ্ন – গুমনামী বাবাই কি নেতাজি? কমবেশি প্রায় সব গবেষকই একটি সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হয়েছেন যে, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তার পরবর্তীকালে সুভাষের গতিবিধি সম্পর্কে উঠে এসেছে একাধিক তথ্য, হয়েছে বিস্তৃত আলোচনাও। বিভিন্ন সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে, মোটামুটি দুটি সমাধানে আসা যায় –
- রাশিয়াতেই বন্দিদশায় থাকাকালীন নেতাজির মৃত্যু হয়।
- রাশিয়া থেকে তিনি ভারতে ফিরে এসেছিলেন এবং আত্মগোপন করেছিলেন গুমনামী বাবার ছদ্মবেশে। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে আশির দশকে মৃত্যু হয় তাঁর।
এখনও পর্যন্ত যত প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং যাচ্ছে, তাতে গুমনামী বাবাই যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু – এ-ধারণা দৃঢ় হচ্ছে দিনকেদিন। শুধুমাত্র এই প্রমাণ ও তর্ক নিয়েই আলোচনা করা যায় পাতার পর পাতা। উৎসাহী পাঠক নিশ্চয়ই সেগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহালও। একাধিক বই, প্রবন্ধ ও অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে আলোচনাও পাওয়া যায় একটু খুঁজলেই। সেই প্রমাণগুলি সম্পর্কে তুল্যমূল্য আলোচনার পরিসর এটি নয়। তবে অনেক বছর ধরে নেতাজির মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে পড়াশুনা করার পর, এবং এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত যাবতীয় যুক্তি ও প্রমাণ বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়, হ্যাঁ, গুমনামী বাবাই নেতাজি ছিলেন। অবশ্য এ-মত একান্তই ব্যক্তিগত।
যে মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে ১৩ লাখ মানুষের উপস্থিত থাকার কথা, আজ তাঁর পাশে মাত্র ১৩ জন।
ব্যক্তিগত ধারণা ছেড়ে এবার একটু নৈর্ব্যক্তিকতায় আসা যাক। সংক্ষেপে বললে, গুমনামী বাবার হস্তাক্ষরের সঙ্গে মিলে গেছে নেতাজির হস্তাক্ষর। এমনকি, গুমনামী বাবার গলা যাঁরা শুনেছেন, নেতাজির কণ্ঠের সঙ্গে মিলও পেয়েছেন অনেকেই। তাঁর ঘর থেকে এমন অনেক জিনিস পাওয়া গেছে, যা দেখে নেতাজির সঙ্গে স্পষ্ট যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। এমনকি, সুভাষ-ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গেই গুমনামী বাবার ব্যক্তিগত পত্রবিনময় হত।
গুমনামী বাবার মৃত্যুর তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫। মৃত্যুর কারণ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি বসবাস করছিলেন উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে, ‘রামভবন’ নামের একটি বাড়িতে। অবশ্য ছয়ের দশক থেকেই হদিশ পাওয়া যায় গুমনামী বাবার। সারা উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ দু-দশক কাটিয়েছেন তিনি। সাক্ষীরা বলেছেন, মাঝেমধ্যেই অন্তর্হিত হয়ে যেতেন তিনি। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে বাইরে কোথাও যেতেন। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসতেন ওই রাজ্যে।
মৃত্যুর তারিখের পাশের জায়গায় জিজ্ঞাসাচিহ্ন। কেন?
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গুমনামী বাবার ঠিকানা ছিল ফৈজাবাদের রামভবন। মৃত্যুর দু’দিন পর, ১৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে তাঁর দাহকার্য হয়। কেন দেরি হল দাহে? এমন আরও প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গুমনামী বাবার দেহ ছিল ভারতের জাতীয় পতাকায় ঢাকা। সৎকারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিরা তাঁর মুখ দেখতে পাননি, কেননা পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছিল ব্যান্ডেজে ঢাকা। সৎকারে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১৩ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ আর পি মিশ্রা, রামকিশোর পাণ্ডা, ডাঃ প্রিয়ব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সরস্বতী দেবী প্রমুখ। শেষকৃত্য চলাকালীন, রামকিশোর পাণ্ডা বলে ওঠেন, 'যে মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে ১৩ লাখ মানুষের উপস্থিত থাকার কথা, আজ তাঁর পাশে মাত্র ১৩ জন।’
গুপ্তার ঘাটে সরযূ নদীর তীরে সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য। তারপর, গুমনামী বাবার স্মৃতিতে সেখানে তৈরি করা হয় একটি সমাধি। সমাধিটি তৈরি করিয়েছিলেন রামভবনের মালিক শক্তি সিং। সমাধিতে গুমনামী বাবার জন্মতারিখ লেখা – ২৩ জানুয়ারি, ১৮৯৭। মৃত্যুর তারিখের পাশের জায়গায় জিজ্ঞাসাচিহ্ন। কেন? গুমনামী বাবার তো ১৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয়েছিল!
প্রসঙ্গত, ভক্ত ও অনুগামীরা তাঁকে 'ভগবানজী' নামেই ডাকতেন। তাঁর আসল নাম অজানা হওয়ায়, পরবর্তীকালে সংবাদ মাধ্যম তাঁকে 'গুমনামী বাবা' নামে অভিহিত করে।
প্রতিবছর, ২৩ জানুয়ারি তাঁর কাছে জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তা-সহ প্রচুর চিঠি আসত। লিখতেন নেতাজি-ঘনিষ্ঠ অনেকেই। রামভবনের ঘর থেকে পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে সেসব চিঠি। নেতাজির জন্মসালও কিন্তু ১৮৯৭-ই।
গুমনামী বাবার মৃত্যু হয়নি। অন্য কারও লাশকে মৃতদেহ সাজিয়ে দাহ করা হয়, এবং রামভবন থেকে অন্তর্ধান করেন তিনি।
পাঠক, এই যে গুমনামী বাবার দাহকার্যে দেরি হল দুদিন, মৃতদেহ ব্যান্ডেজে ঢাকা ছিল পুরো, সৎকারে উপস্থি ছিলেন মাত্র ১৩ জন – এসবের সঙ্গে কি অন্য কোনো ঘটনার মিল পাচ্ছেন? তাইহোকুর তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনা ও তার পরবর্তী ঘটনাবলির সঙ্গে কি মিল নেই এই চিত্রনাট্যের? মিল পাওয়া যায় তাইহোকুতে নেতাজির সৎকার-জনিত ঘটনার সঙ্গেও। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন উঠে আসে, তা হল, গুমনামী বাবার কি ওই দিন আদৌ মৃত্যু হয়েছিল, না ফৈজাবাদ থেকে আবার অন্তর্ধান করেছিলেন তিনি?
গুমনামী বাবার কোনো ডেথ সার্টিফিকেট ছিল না। ছিল না সৎকারের অনুমতিপত্রও। খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া মৃত্যুর কথা জানেওনি কেউ, যতক্ষণ না সৎকার হচ্ছে। জীবিতাবস্থায় গুমনামী বাবার মুখ দেখেননি প্রায় কেউই। মৃত্যুর পরেও না। সত্যিই কি মৃত্যু হয়েছিল?
যদি ১৮৯৭ সালেই জন্ম হয়, ১৯৮৫ সালে তাঁর বয়স ৮৮। এই বয়সে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আবার অন্তর্ধানের কথা ভাবাটা খানিক অবাস্তব। যদি তা সত্যি হয়ও, তারপর কোথায় গেলেন তিনি? কী করেই বা শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হল তাঁর? বেশ কয়েকজন গবেষক, সাংবাদিকের অভিমত – ১৬ সেপ্টেম্বর গুমনামী বাবার মৃত্যু হয়নি। অন্য কারও লাশকে মৃতদেহ সাজিয়ে দাহ করা হয়, এবং রামভবন থেকে অন্তর্ধান করেন তিনি। যাবতীয় জিনিসপত্র রেখেই যান, যাতে লোকের মনে বিশ্বাস জন্মায় যে তিনি সত্যিই মারা গেছেন। কিন্তু ওই বয়সে আবার অন্তর্ধানের প্রয়োজন হল কেন তাঁর? কেউ কেউ বলেন, ফৈজাবাদে দ্রুত এই কথা ছড়িয়ে পড়ছিল যে, গুমনামী বাবাই নেতাজি। তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ্যে আসছিল একে একে। বাংলার নেতাজি-ঘনিষ্ঠরাও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে, নিজের পরিচয় শেষ বয়সে আর প্রকাশ্যে আনতে চাননি বলেই রামভবন তথা ফৈজাবাদ ছেড়ে চলে যান।
যদি ১৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু না-ই হয়, তাহলে কোথায় গেলেন গুমনামী বাবা? উত্তর আজও অজানা।
আর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা আগেই বলেছি। এখন অবধি প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য ও প্রমাণ পড়ে, আমার বিশ্বাস, তিনিই নেতাজি। আর, কিছু গোপন ও নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত এ-বিষয়ে নিশ্চয়তাও পেয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে ইতিহাসের বিশ্লেষণ হয় না। কাজেই সেটা সরিয়ে যুক্তি দিয়েই ভবিষ্যতের ভাবনাচিন্তা এগোক।
সবকিছুর পরেও, গুমনামী বাবার মৃত্যুর সঙ্গেও মিশে রইল রহস্য। নেতাজির মতোই। জেগে রইল সেই প্রশ্নও – গুমনামী বাবাই যদি নেতাজি হন, শেষ পর্যন্ত কী হল তাঁর?