‘আমার কারোর থেকে উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই’, হিটলারকে জবাব সুভাষচন্দ্রের

বার্লিনে সুসজ্জিত ঘরের ভেতর বসে বই পড়ছেন এক ব্যক্তি। ঘরের ভেতর, বাইরে সশস্ত্র উর্দিধারী মানুষেরা। এই উর্দিকে এতদিনে চিনে ফেলেছে গোটা বিশ্ব। চল্লিশের দশকের শুরুর সময় তখন। বার্লিন, অর্থাৎ জার্মানি মানেই মূর্তিমান শয়তান! নাৎসিদের হুংকারেই তো শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর এমন পরিস্থিতির মাঝেই বসে আছেন ওই ভারতীয় ব্যক্তি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, বেরিয়ে পড়েছে টাক। শরীর কিন্তু টানটান; চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা চোখে এক অদ্ভুত জ্যোতি। বসে আছেন, বই পড়ছেন। অপেক্ষা, কখন ‘তিনি’ আসবেন… 

অবশেষে এলেন ‘তিনি’। সামরিক পোশাক, বুকে নাৎজি স্বস্তিক চিহ্ন আর সেই ‘বিখ্যাত’ মাছিগোঁফ। সামনেই দাঁড়িয়ে ফ্যুয়েরার অ্যাডলফ হিটলার। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু জায়গা ছেড়ে উঠলেন না। এ কী? কেন? সটান জবাব, ইনি হিটলার নন; একজন বহুরূপী। এরপর আরও একজন এলেন, এবং এবারও একই ঘটনা। সুভাষ উঠলেন না। একই ঘটনা এরকম বেশ কয়েকবার ঘটল। হঠাৎই একটা হাত সুভাষের কাঁধে নেমে এল। এবার উঠে দাঁড়ালেন তিনি, বাড়িয়ে দিলেন হাত। হ্যাঁ, এইবার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আসল অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের যে এরকম বেশ অনেক বহুরূপী রয়েছে, সেটা তো প্রায় সবাই জানে। কিন্তু এই ভারতীয় কী করে আসল হিটলারকে চিনে নিলেন? আগে কি কখনও দেখেছেন? জবাবে একটু হেসে উঠলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর পিঠে হাত রাখার মতো সাহস একমাত্র আসল হিটলারেরই আছে, আর কারোর নেই!

এই কাহিনিটি আজ রীতিমতো কিংবদন্তির পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নেতাজি সুভাষ এবং হিটলারের প্রথম সাক্ষাৎ - তা কি যে-সে ব্যাপার? দুজনেই তো ইতিহাসের দুই চরিত্র। তবে নেতাজির জার্মানি যাত্রাও কম ঐতিহাসিক নয়। একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। ১৯৪১ সাল। তখন বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে আতঙ্কের আবহাওয়া, তার মধ্যেই চলছে স্বাধীনতার লড়াই। এমন পরিস্থিতিতে গৃহবন্দি সুভাষ ঠিক করলেন, আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। যদি কিছু করতে হয়, তাহলে দেশের বাইরে যেতে হবে। সেখানের ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ করে শুরু করতে হবে স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাকি কাহিনি তো কিংবদন্তির তকমা পেয়েছে। রাতের অন্ধকারে ব্রিটিশদের সামনে দিয়ে পালিয়ে আসা, তারপর বোবা-কালা সেজে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া; সেখান থেকে জার্মানি। সুভাষের মাথায় তখন একটাই চিন্তা— স্বাধীনতা। দেশের স্বাধীনতা… 

আচ্ছা, সুভাষ তো সমকালীন আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে যথেষ্ট খবর রাখতেন। তাঁর বিচক্ষণতা, মেধা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবে না। তাহলে কি তিনি হিটলারের আসল স্বরূপের কথা জানতেন না? নাৎসিদের হিংস্রতার কথা জানতেন না? নিশ্চয়ই জানতেন। তবুও কেন জার্মানিতে গিয়েছিলেন? হিটলার ও অন্যান্য নাৎসি নেতাদের সঙ্গেও দেখা করলেন। এই বিষয় নিয়ে নানা বিতর্ক, নানা প্রশ্ন আমাদের। জার্মানিতে নেতাজির কার্যক্রম নিয়েও অনেক ধোঁয়াশা। তাহলে? ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’— এই প্রবাদ বহু আগে থেকেই আমরা শুনে এসেছি। নেতাজি সেটাকে বাস্তবে নিয়ে এলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স যথেষ্ট বিপদে পড়েছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতেও স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছিল। এটাই সুযোগ ছিল ব্রিটিশকে কোণঠাসা করার। আর সেখানেই নেতাজির মনে হয়েছিল, শুধু ঘর থেকে নয়, ঘরের বাইরে থেকেও আক্রমণ শানানো উচিত। আর তার জন্য যদি জার্মানির সামান্য সাহায্যও পাওয়া যায়, সেটাই অনেক। তবে সুযোগ এলে তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন সুভাষ। 

আরও পড়ুন
দুর্ভিক্ষে-বন্যায় ধ্বস্ত বাংলা, রিলিফ ফান্ড তৈরি করলেন প্রফুল্লচন্দ্র, সঙ্গী তরুণ সুভাষ

হিটলারের সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাও ছিল যথেষ্ট রোমাঞ্চকর, এবং ‘সুভাষিত’। জার্মানিতে গিয়েই ফ্যুয়েরারের দেখা পাননি সুভাষ। বহুদিন পর দুজনের দেখা হয়। সুভাষের সঙ্গে দোভাষী হিসেবে ছিলেন তাঁর জার্মান বন্ধু অ্যাডাম ভন ট্রট। অন্যদিকে হিটলার এবং তাঁর সঙ্গে রিবেনট্রপ, হিমলারের মতো উচ্চপদস্থ নাৎজি নেতারা। সুভাষের দাবি ছিল ভারত সম্পর্কে জার্মানি ও হিটলারের অবস্থান স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হোক। এই যুদ্ধে ভারতের সমর্থন পেতে হলে ভারতের স্বাধীনতা নিয়েও সাহায্য করতে হবে। ইতালি, জাপানও রাজি হয়েছে; এখন বাকি জার্মানি। কিন্তু হিটলার সেই পথে হাঁটলেন না। জার্মানি তখন রাশিয়ার সমরাঙ্গনে; বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত নাটকীয় মুহূর্ত চলছে। এদিকে ভারত তো অনেকটা দূর। সেইদিকে মনোযোগ দেওয়া মানে জার্মানির স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়া। হিটলার নানাভাবে যুক্তির জাল বুনতে লাগলেন। অন্যদিকে সুভাষও সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদি একটু বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু হিটলার নাছোড়বান্দা। একটা সময় বলেই ফেললেন সুভাষচন্দ্র বসু— ‘সারা জন্ম রাজনীতি করে কেটেছে, আমাকে উপদেশ দিতে হবে না।’

ভাবুন একবার! সামনে বসে আছেন যিনি, তাঁর নাম অ্যাডলফ হিটলার। বসে আছেন হিটলারেরই খাস ডেরায়। আর সেখানেই কিনা তাঁর মুখের ওপর এমন জবাব সুভাষের! নেতাজির বলা কথাগুলো যদিও একটু হালকা করে জার্মানিতে অনুবাদ করে দেন ভন ট্রট। কিন্তু তাঁর উদ্যত ভাব, চোখ-মুখের তেজ তো লুকানো যায়নি। জার্মানরা সেদিনই হয়তো চিনে নিয়েছিলেন এই বাঙালিটিকে। বাকি পাঁচজনের মতো নন ইনি। হিটলার সেভাবে সাহায্য না করলেও সুভাষের বাকি পরিকল্পনার ব্যাপারে অবাধ ছাড় দিয়েছিলেন। জার্মানিতে বসেই নিজের পরবর্তী কাজ শুরু করলেন তিনি…     

আরও পড়ুন
খুলনার ফাতেমা জুয়েলার্সের সঙ্গে জড়িয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কীভাবে?

জার্মানি থেকেই প্রথমবার ভারতে সম্প্রচারিত করা হয় আজাদ হিন্দ রেডিও। সেখানে নেতাজির বক্তৃতা যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিভিন্ন খবরের আদানপ্রদান। প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গবদ্ধ করার কাজটিও শুরু করেছিলেন তিনি। এছাড়াও জার্মানিতে গিয়ে দেখলেন, প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো ভারতীয় সৈনিক বন্দি রয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এঁরা ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করছিলেন। তারপর নাৎজিদের হাতে বন্দি হয়ে এখানে এসেছেন। সুভাষচন্দ্র বসুর কথায় এদের সবাইকেই ছেড়ে দেওয়া হল। এবং এদেরই অনেককে নিয়ে তৈরি করলেন তাঁর প্রথম সেনাবাহিনী। এবং এই ভারতীয় সৈন্যরাই সুভাষের বীরত্ব দেখে তাঁর নাম দিল ‘নেতাজি’। সেই দিন থেকে সুভাষ আর স্রেফ সুভাষ হয়ে রইলেন না; জন্ম নিল ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’। 

বিশ্বযুদ্ধ যত এগোতে থাকে, ততই হিটলার এবং নাৎজি জার্মানি পরাস্ত হতে থাকে। আর বেশিদিন যে জার্মানির সাহায্য পাওয়া যাবে না, সেটা বুঝতেই পেরেছিলেন নেতাজি। এবং এখান থেকে বেরিয়ে চলে যেতে হবে জাপানে। রাসবিহারী বসু অপেক্ষা করে আছেন সেখানে। প্রস্তুত হলেন সুভাষ। এবার দীর্ঘ যাত্রা। এই যাত্রা স্বাধীনতার। এই যাত্রা ভারতের মুক্তির…

আরও পড়ুন
মুসলিম লিগের সঙ্গী সুভাষচন্দ্র - বলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সাক্ষী কিশোর মৃণাল

তথ্যসূত্র-
১) ‘Strange Bedfellow’, Sudip Bose, Bookforum
২) ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ মানতে পারেননি গৃহবন্দি সুভাষ’, কলকাতা ২৪X
৩) ‘Subhas Chandra Bose in Nazi Germany’, Sisir K Majumder, Revolutionary Democracy 

Powered by Froala Editor

More From Author See More