মাত্র এক মাস আগের কথা। সেপ্টেম্বর মাসেই ইউরোপের বুকে অভিনব এক ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেছিল টটেনহাম হটস্পার। ‘গেম জিরো’-খ্যাত এই ম্যাচের কার্বন ফুটপ্রিন্ট ছিল শূন্য। টটেনহামের এই উদ্যোগ দৃষ্টান্তমূলক, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে, ইউরোপিয় ফুটবল পরিমণ্ডল বিষিয়ে তুলছে পৃথিবীকে। হ্যাঁ, এমন তথ্যই এবার উঠে এল বিবিসি-র তদন্তমূলক সাংবাদিকতায়। সাংবাদিক জন স্টানটন এবং ডেভিড লকহুডের রিপোর্ট জানাচ্ছে, উয়েফার সাম্প্রতিক পরিকাঠামো আগামীতে কার্বন ফুটপ্রিন্টকে বাড়িতে তুলবে আরও দ্রুত গতিতে।
কিন্তু ফুটবল ম্যাচের আয়োজন কীভাবে ত্বরান্বিত করছে দূষণকে? ইংল্যান্ড, ইতালি কিংবা স্পেনের মতো দেশগুলির ক্লাব ফুটবলের আবহকে সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতাগুলির দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে বিষয়টা। উয়েফার পরিকাঠামো অনুযায়ী ফাইনাল ম্যাচ বাদ দিলে, প্রতিদলই দু’বার করে খেলার সুযোগ পায় বিপক্ষের সঙ্গে। একটি ঘরের মাঠে, অন্যটি বিপক্ষের মাঠে। ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’, ‘ইউরোপা লিগ’, ‘উইমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগ’-এর মতো টুর্নামেন্টগুলি আন্তর্জাতিক হওয়ায়— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলিকেও পাড়ি জমাতে হয় বিদেশে। ফলত, আকাশপথই একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে ওঠে।
বিবিসির রিপোর্ট জানাচ্ছে, শুধু উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ক্ষেত্রেই গ্রুপ পর্বের ৯৬টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৬টি ম্যাচে অনুকূল পরিস্থিতি থাকে। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট ক্লাব দুটির মধ্যেকার দূরত্ব ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে। অন্যদের গড়ে অতিক্রম করতে হয় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার পথ। আর ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল হওয়ায় প্রতিটা দলের কাছেই খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা। মাত্র ৩০-৩৫ জন খেলোয়াড় এবং কোচিং স্টাফ নিয়ে আস্ত একটি বিমান পাড়ি দেয় ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। গণ-পরিবহন এড়িয়ে এই বিশেষ ব্যবস্থার জন্য মাথাপিছু ১০৭৮ কেজি কার্বন মেশে প্রকৃতিতে। গোটা প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড় কিংবা কোচিং স্টাফেদের মাথা পিছু কার্বন ফুটপ্রিন্ট থাকে ৪০০০ কেজি। যা সাধারণ মানুষের গোটা বছরের গড় কার্বন ফুটপ্রিন্টের অর্ধেকেরও বেশি।
এতো গেল শুধুমাত্র উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের হিসেব। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে গোটা ছবিটা। বর্তমানে প্রতিবছর সব মিলিয়ে ৭টি ক্লাব কম্পিটিশন আয়োজন করে উয়েফা। চলতি বছর থেকে ‘কনফারেন্স লিগ’ এই তালিকায় সংযুক্ত হওয়ায় সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮টিতে। নয় নয় করে, শুধুমাত্র এই একটি টুর্নামেন্টের জন্যই বৃদ্ধি পাবে ২৮৮টি গ্রুপ ম্যাচ। তার বাইরে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল, ফাইনাল তো রয়েইছে। ফলে কনফারেন্স লিগের জন্য ফুটবল-সংক্রান্ত কারণে ইউরোপে দূষণের পরিমাণ বাড়তে চলেছে আরও ২০ শতাংশ। পাশাপাশি আগামীতে বাড়তে চলেছে চ্যাম্পিয়নস লিগে অংশগ্রহণকারী মোট দলের সংখ্যাও।
এবার আসা যাক ইউরোপের জাতীয় ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতাগুলির দিকে। হিসাব বলছে ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ইউরোপে ক্লাব কম্পিটিশনের সংখ্যা বাড়তে চলেছে ৫৫ শতাংশ। তাতে যেমন ফুটবলার এবং সংশ্লিষ্ট স্টাফেদের পরিচলন বাড়বে গোটা মানচিত্রজুড়ে। তেমনই বাড়বে দর্শকদের সংখ্যাও। আর পরিবহন ব্যবস্থার ব্যস্ততা বাড়ার অর্থ কার্বন ফুটপ্রিন্ট বৃদ্ধি পাওয়া।
বছর কয়েক আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুরোধ মেনে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল উয়েফা। প্রতি ম্যাচে তো বটেই, ওয়েবসাইটেও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য একাধিক ট্যাগলাইন ব্যবহার করেছিল ইউরোপের ফুটবল নিয়ামক সংস্থাটি। আজও অব্যাহত ভাবেই ‘ক্লাইমেট লিডারশিপ’-এর বিজ্ঞাপন চলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের ওয়েবসাইটে। কিন্তু বাস্তবে আদৌ কি তার প্রভাব পড়ছে কোনো? দূষণ নিয়ন্ত্রণের কতটাই বা দায় নিচ্ছে তারা? সেখানেই থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের তৈরি ফুটবল-সংক্রান্ত দূষণ নিয়ন্ত্রণের শাখা ‘ইউনাইটেড নেশনস স্পোর্টস ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্ক’-ও নিশ্চুপ সাম্প্রতিক পরিমণ্ডলে। ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আদৌ কি সুপরিকল্পিত পরিকাঠামোর সন্ধান দিতে পারবে তারা? জানা নেই উত্তর…
Powered by Froala Editor