১৯৩৯ সাল। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে তখন শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর বাংলা তথা ভারতের উপর চেপে বসেছে ইংরেজ সরকারের দানবিক ফাঁস। সশস্ত্র সংগ্রামের স্পন্দনে যত এগিয়ে আসছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, তত যেন সভ্যতার মোহময়ী মুখোশ খুলে নৃশংস হয়ে উঠছে ইংরেজ। তারই মধ্যে এসে পড়ল আরেকটি অক্টোবর মাস। পরাধীনতার শিকল পরেও বরণ করে নিতে হবে মা দুর্গাকে। আর অসুর দলনী মাতৃমুক্তির থেকে শক্তি নিয়ে বধ করতে হবে অসুররূপী ইংরেজকে। ১৮ অক্টোবর (৯ কার্তিক, ১৩৪৬), মহাষষ্ঠীর দিন মিনার্ভা মঞ্চে অভিনীত হল মহেন্দ্র গুপ্তের ‘দেবী দুর্গা’ নাটক। দেবীবন্দনার রসে জারিত সংগীতের ডালি সাজিয়ে দিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)। পেশাদার মঞ্চের পৌরাণিক নাটকে অগ্ন্যুৎপাতের মতো বেজে উঠল নিষ্পেষিত জাতির রণহুঙ্কার।
বাংলা থিয়েটারের অবস্থা তখন একেবারেই ভালো নয়। সামাজিক-ঐতিহাসিক-পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে মুখ ঢেকে চলছে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ করেনি সেদিনের থিয়েটার। নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ভয় তো ছিলই, আসলে এক স্থবির মূল্যবোধ গ্রাস করেছিল সেদিনের মঞ্চগুলিকে। ‘দেবী দুর্গা’ নাটকটিও আপাতদৃষ্টিতে তার ব্যতিক্রম নয়। মেথস মুনির পরামর্শে ভক্ত সমাধি মুক্তিকামনা করলেন দশভূজা দুর্গার কাছে। অন্যদিকে রাজা সুরথ চাইলেন রাজত্ব বিস্তারের আশীর্বাদ। দুজনের মনস্কামনাই পূর্ণ হল কিরাতকন্যাবেশী দেবীর আগমনে। অলৌকিক ঘটনা ও মঞ্চমায়ার আতিশয্যের মধ্যে নজরুলের লেখা গানগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েও বিচ্ছিন্ন। যেন শুধু মঞ্চের নাটক নয়, সমাজ-ইতিহাসের এক বিশেষ ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে তিনি ডেকে নিচ্ছেন মহামায়াকে।
কাজী নজরুলের গানে-কবিতায় শক্তিদায়িনী দেবীর বন্দনা নতুন কিছু নয়। ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যগ্রন্থের ‘আগমনী’ কবিতার দেশের রণাঙ্গনে আহ্বান করেছিলেন ‘রণ-রঙ্গিণী জগতমাতা’কে। দেখেছিলেন ‘দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে বাজে দশ প্রহরণ’। আবার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’-র পরে করতে হয়েছিল কারাবরণ। ‘মাটির ঢেলা’-কে তিনি হয়ে উঠতে বলেছেন ‘সর্বনাশী’। ‘ঢাল তরবার’ নিয়ে সংহার করতে বলছেন ‘অত্যাচারী শক্ত চাঁড়াল’-দের। স্পষ্টতই ইংরেজ শাসনের রক্তপিপাসার বিসর্জনের ঢাক বেজে ওঠে তাঁর কবিতায়। ১৯৩০ সালে মনমোহন মঞ্চে অভিনীত হয় মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটক। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের ছায়া আছে যেখানে। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গানের পাশাপাশি ধরিত্রী চরিত্রের গানগুলি লিখেছিলেন নজরুল। নাটকের শেষ মুহূর্তে কারাগারে ‘মহামায়া’-র আবির্ভাব রক্ষা করে শিশু কৃষ্ণকে। অন্ধকারের উৎস থেকে জন্ম নেওয়া এক অবতারের হাতে মৃত্যু নিশ্চিত হয় কংসের। তার প্রাকমুহূর্তে শোনা যায় ধরিত্রীর গান,
“ধরি অজানা পথ, আসিল অনাগত,
জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে মাভৈঃ।।”
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলে প্রথম দুর্গাপুজো
‘দেবী দুর্গা’ সেই পর্যায়ের নাটক নয়। তবু আশ্চর্য হতে হয়, সেই নাটকেও সংগীত রচনার ব্যঞ্জনায়। সমকালীন দর্শক টের পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই, তবে বাংলা নাটকের ইতিহাস থেকে প্রায় মুছতে বসা এক নাটকের পাতা খুলতে ইচ্ছে হয় এক বিশেষ কারণে। নাটকের শুরুতে মেধস মুনির আশ্রমে বেদ গানের পর আহ্বান জানানো হয় ঊষাকে। তার বর্ণনা দিচ্ছেন নজরুল,
আরও পড়ুন
কৃষ্ণের হোলি খেলা নিয়ে গান লিখলেন নজরুল, রেকর্ডে কণ্ঠ মহম্মদ রফির
“তিমির কারারুদ্ধা ধরণী ঊর্ধ্বে চাহে,
মুক্ত করি তারে আনো উদার আলোতে।।”
আঁধার রাত্রি ঘুচে নতুন সূর্যের আগমনবার্তা। কিন্তু ‘তিমির কারারুদ্ধা’ পৃথিবী উচ্চারণের মধ্যে লুকিয়ে আছে আসল উদ্দেশ্য। শুধু এই প্রকৃতি নয়, ভারতের আকাশেও আজ অন্ধকার। সময় এসেছে তাকে উদার আলোতে নিয়ে আসার। নাটকে দুয়েক জায়গায় ‘দুঃখক্লিষ্ট ভারত’-কে উদ্ধারের প্রসঙ্গ এলেও তা বড়ো ক্ষীণ। দুর্গাস্তবের মাধ্যমে দেশমুক্তির আরাধনা বন্দি হয়ে যায় পুরাণের জটাজালে। নজরুলের গান দূর করে সেই অভাব। দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে রাজা সুষেণের লোকেরা সুরথকে খুঁজে না পেয়ে আক্রমণ করে কিরাতপল্লিতে। পুড়িয়ে দেয় ঘর-বাড়ি, রেহাই নেই শিশু-মহিলাদের। ভারতের দুর্গতিকে কিরাতপল্লির মধ্যে খুঁজে নেওয়ার দুর্বল চেষ্টার মধ্যেও গর্জে ওঠেন নজরুল। কিরাতদের যুদ্ধঘোষণার মধ্যে বেজে ওঠে গান,
“ভারত-শ্মশানে শবের মাঝে শিব জাগাও
তাথৈ তাথৈ নৃত্যে পাষাণের ঘুম ভাঙাও”
এবার আর শুধুমাত্র বরাভয়প্রদানকারী দেবী দুর্গা নয়, ডাক পড়েছে সাক্ষাৎ ‘চণ্ডিকা মহাকালী’-র। রক্ত রাগে লাল হয়ে উঠছে দশদিক। আগুন জ্বলুক দৈত্যের কারাগারে। গলায় নেচে উঠুক নৃমুণ্ডমালা। যেভাবে বহুরূপে মধুকৈটভ, শুম্ভ-নিশুম্ভ বিনাশ করেছেন আপন শক্তিতে, তার ছন্দেই জেগে উঠুক প্রলয়ঙ্করী করালি।
চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে খুলে যায় সুষেণের বিশ্বাসঘাতকের মুখোশ। কিরাতদলের হাতে বন্দি তিনি। অত্যাচারী রাজার মুখে এই প্রথমবার শোনা যায় ‘ক্ষমা’ শব্দটি। কিন্তু না, তার যোগ্য নয় সুষেণ। দেবীপূজার পুণ্যলগ্নে সমস্ত আসুরিক শক্তির সঙ্গে চরম দণ্ডের ব্যবস্থা করা হয় সুষেণের। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও তখন তুঙ্গে। ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে গান্ধীজি-সুভাষচন্দ্র বসুর পথ। প্রবল অত্যাচারেও স্তব্ধ করা যায়নি সশস্ত্র আন্দোলনপন্থী তরুণ যুবক-যুবতীর আত্মবলিদানের স্পর্ধাকে। নাটকের পরের দৃশ্যে এক অনাগত ভবিষ্যতের বার্তা দেন নজরুল,
“এ দুর্দ্দিন রবে না তোর আসবে শুভদিন
নূতন আশায় বুক বাঁধ রে অন্ন বস্ত্র হীন।।”
যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন পুব আকাশে সূর্য ওঠার রক্তাভ আলোকরেখাকে। এবার শুধু উঠে দাঁড়াতে হবে সাহস করে। মৃত্যু? যার সঙ্গে স্বয়ং দানবদলনী রয়েছে, তার ভয় কীসের? তাঁর উপরেই ছেড়ে দিতে হবে কর্মফলের হিসেব। সুখে রাখা বা দুঃখ দেওয়া তো তারই হাতের খেলা। তাঁকে ভরসা করে অস্ত্র তুলে নে হাতে,
“তুই দেখবি সেদিন রইবি না আর এমন পরাধীন।।”
নজরুলের কলমের জাদু বাস্তবরূপ লাভ করেছিল তার আট বছরের মধ্যেই। হয়তো তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে পুরোপুরি মেলেনি স্বাধীনতার রূপ। তবুও গানে-কবিতায় মহাপ্রলয়ের তাথৈ নৃত্যের সুর চিনে নিয়েছে এক যুগান্তরের সন্ধান। শান্ত-স্নিগ্ধ দেবীকে পরিয়েছিলেন রণাঙ্গনের সাজ। মহাষষ্ঠীর পুণ্যলগ্নে শত বিধিনিষেধের পেশাদার মঞ্চে বোধন হয়েছিল ‘দেবী দুর্গা’-র।
Powered by Froala Editor