প্রেম হোক বা সন্তানশোক, রবীন্দ্রনাথের থেকে সর্বাংশে আলাদা নজরুল

"তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি।"

আটত্রিশ বছরের এক পুরুষ লিখছেন এই চিঠি। ষোলো বছর পর, তাঁর এক প্রেমিকাকে। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে স্থিরতা এসেছে। শান্ত হয়েছে অভিমানও। পুরনো সেই ক্ষত আজ আর ব্যথা দেয় না তেমন। শুধু, মাঝেমধ্যে মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। অথচ, দীর্ঘশ্বাসে হাহাকার লুকোতে পারেন না তিনি। পারেননি কোনোদিনই। গভীর ক্ষত, অসীম বেদনার কথাও উঠে আসছে তাই। পুরুষটি, কাজী নজরুল ইসলাম (Kazi Nazrul Islam)।

আদৌ কি কখনও নিজেকে লুকোতে পেরেছিলেন নজরুল? শুধু কবিতা-গল্প-উপন্যাস-গান-চিঠিতে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তো বারবার ফুটে বেরিয়েছে তাঁর অপারগতা। নজরুল গোপন করতে জানতেন না। আবার, নজরুল বাঁচতে জানতেন। উদ্দাম ও দিলখোলা এই মানুষটি তাই আঘাতে চিৎকারও করেছেন। ছটফটিয়ে উঠেছেন। কখনও তা প্রকাশ করেছেন, কখনও দাঁতে দাঁত চেপে সেই কষ্ট ঢেলে দিয়েছেন লেখায়। আবেগকে সংযত করে তাকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার কসরৎ জোর করে করেননি তিনি। হয়তো যাপনই তাঁকে তৈরি করেছে এভাবে।

মাঝেমাঝেই মনে হয়, আঘাত তো রবীন্দ্রনাথও কম পাননি জীবনে, কিন্তু তাঁর যাপন তাঁকে সংযত হতে শিখিয়েছিল। যে-কারণে চূড়ান্ত দুঃখেও তিনি সামলাতে পেরেছেন নিজেকে। ভেতরের তোলপাড় বাইরে আনতে দেননি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য ছিল, যে দুঃখ তাঁর নিজের, তাকে সকলের সামনে এনে ফেললে সেই দুঃখের গুরুত্ব ছোট হয়ে যাবে। সেহেতু তিনি শাসন করেছেন নিজেকে। কষ্টকেও লেখায় চালিত করেছেন মার্জিত ভঙ্গিতে। প্রেমে হোক, বা মৃত্যুশোকে। সন্তান হারানোর ব্যথায় জর্জরিত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন - ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়/কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে হায় হায়’। সেই গানেই লিখলেন, ‘যাহা যায় আর যাহা কিছু থাকে/সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে/তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহামহিমায়।’ রবীন্দ্রনাথ পড়লে, সান্ত্বনা পাওয়া যায়। সামলানো যায় নিজেকে। প্রবল মনোবেদনাতেও, দূরে দেখতে পাওয়া যায় ক্ষীণ এক আশার আলো।

আরও পড়ুন
কৃষ্ণের হোলি খেলা নিয়ে গান লিখলেন নজরুল, রেকর্ডে কণ্ঠ মহম্মদ রফির

সেখানে নজরুল ভেঙে পড়েন, চিৎকার করে কাঁদেন। নজরুল হাহাকারের কবি। রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানব নন, হতে চাননি তিনি কোনোদিনই। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত তাঁর প্রতিক্রিয়া। সন্তানশোকে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন নজরুলও। লিখলেন – ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয় ফিরে আয়/তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল অকালে ঝরিয়া যায়।’ সটান। গানের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা নেই, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। আমি কষ্ট পাচ্ছি, এটা সত্য, অতএব তারই প্রকাশ হবে লেখায় – এমন ভানহীন বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন নজরুল, বারবার।

আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী

ব্যক্তিগত জীবনেও তো, বারবার... বারবার... বারবার...। বুলবুল মারা যাওয়ার পর দিগভ্রান্ত নজরুল শরণ নিলেন যোগীবর বরদাচরণ মজুমদারের। শোকসন্তপ্ত পিতা চাইলেন, ধ্যানের মাধ্যমে বুলবুলের দেখা পাওয়ার। পেলেনও। সেই অনির্বচনীয় অনুভূতির কথা লিখেছিলেন তিনি। আবার, স্ত্রী প্রমীলা দেবী যখন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী, নজরুল ছুটে গেলেন বীরভূমের লাভপুরে। সেখানকার এক পুকুরে স্নান করে, সেই পুকুরের মাটি নিয়ে এলেন। বিশ্বাস, সেই মাটি প্রমীলার পায়ে লাগালেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। এমনই ভ্রান্ত-অভ্রান্ত ধারণায় গড়া মানুষটি। সজীব একজন মানুষ। যেন আর পাঁচজনের মতোই, আলাদা কেউ নন।

আরও পড়ুন
জন্মস্থান থেকে সরে যাচ্ছে নজরুল সংগ্রহশালা, এমনটাই কি কাম্য ছিল?

প্রেমেও ঠিক তাই। কৈশোরে, গ্রামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন নজরুল। পরে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য কোথাও। সেই ব্যথা ভোলেননি তিনি। ‘ব্যথার দান’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে তাই লিখলেন –

"মানসী আমার! মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে
ক্ষমা করো নি,
তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত ক’রলুম।"

আবার, পরিণত যৌবনে ফজিলতুন্নেসা-কে লেখা একের পর এক চিঠি – সেগুলিও কি সাক্ষ্য দেয় না তাঁর উচ্চকিত প্রকাশভঙ্গির? প্রেম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা যাঁকে জর্জরিত করেছে প্রতিবার, সেই কবি চাইলে আবেগ সংযত করতেই পারতেন। তিনি তা করেননি। আর সে-কারণেই তিনি নজরুল।

নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে ভেঙে যায় ১৯২১ সালে। তার ষোলো বছর পর, চিঠিতে লিখছেন -

"তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।"

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একবার বলেছিলেন – ‘দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মতো কীটসের মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে – তুই প্রস্তুত হ।’ রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন। নজরুল আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখেননি কখনওই। আনন্দ ও বিষাদকে সমানভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি। পথ বদলাননি বা আটকে দেননি। থেমেও গেলেন অকালে। পৃথিবী বুঝি তাঁর আবেগের বিস্ফোরণ সহ্য করতে পারছিল না আর?

তবু তাঁকে উদ্দাম ভালোবাসা যায়। এই স্বচ্ছতার জন্যেই। আড়াল সরিয়ে, নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য। ভানহীন এক জীবন বেঁচেছেন তিনি। প্রবল অভিমানে, রবীন্দ্রনাথের মতো শান্ত হয়ে মেনে নেননি। গুমরে উঠে বলেছেন – ‘ভুলে যাও, মোরে ভুলে যাও একেবারে।’

প্রেমের এও এক দিক। নজরুল জানতেন।  

Powered by Froala Editor