শেষকৃত্যের সময়েও দেখা যায়নি চারু মজুমদারের মুখ, আজও অমীমাংসিত সেই ব্যান্ডেজ-রহস্য

আজকাল একটা কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ‘আর্বান নকশাল’। এমন একটা শব্দের অর্থ বুঝতে প্রথমে একটু খটকা লাগতে পারে। নকশালদের রাজনীতির সঙ্গে শহর এবং গ্রাম দুইই জড়িয়ে। কিন্তু তার চেহারাটা ঠিক কেমন? উত্তর খুঁজতে চলে যেতে হবে কলকাতা মনুমেন্টের নিচে। দিনটা ১৯৬৭ সালের ১১ নভেম্বর। স্মৃতি উস্কে দিয়ে যায় কি দিনটা? না বোধহয়। কিন্তু সেদিন উত্তাল ছিল শহরের রাজপথ। একটু একটু করে উষ্ণতা জমছিল আগে থেকেই। সেবছর মে মাসে নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের মিলিত প্রতিরোধ তখন শহরের বহুবিভক্ত কমিউনিস্ট রাজনীতিকে পথ দেখাতে শুরু করেছে। আর সেইসঙ্গে উঠে আসছে একটাই নাম। চারু মজুমদার।

অবশেষে সবার সামনে উঠে দাঁড়ালেন চারু মজুমদার। চোখেমুখে এক দৃপ্ত স্বপ্নের আলো। কিন্তু চারু মজুমদার উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘নকশালবাড়ির নেতা আমি নই, নকশালবাড়ির নেতা কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, কদম মল্লিক, খোকন মজুমদার। নকশালবাড়ির কৃষক জমি বা ফসলের জন্য লড়াই করেনি। তারা লড়াই করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য।’

হয়তো এভাবেই চেনা যায় আসল মানুষটাকে। সারা জীবন রাজনীতির সঙ্গেই থেকেছেন। অথচ আগে তাঁকে কেউ নেতার আসনে বসিয়েছেন কী? সেই সময়টা যখন এল, তখন চারু মজুমদারের বয়স ৫৯। আসলে সময়টা এসেছিল নিজের নিয়মেই। শুধু চারু মজুমদার প্রথম চিনেছিলেন তাকে। আর আর্বান নকশালিজমের জন্ম বোধহয় সেদিন থেকেই। রাজনীতির মূল কাণ্ডারি কিন্তু ছিলেন কৃষক এবং শ্রমিকরাই। আর তাই নেতার জায়গাটা কানু সান্যাল বা জঙ্গল সাঁওতালদেরই প্রাপ্য। কিন্তু নতুন ধারার বিপ্লবের লক্ষে যে অসংখ্য ছাত্র-যুব পথে নেমেছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশই কিন্তু ছিল শহরের শিক্ষিত সম্প্রদায়। আর তাঁদের সামনে মুখ হয়ে ছিলেন চারু মজুমদার।

১৯১৯ সালের ১৫মে রাজশাহী জেলার মাতুলালয়ে জন্ম গ্রহণ করলেন চারু মজুমদার। বাবা বীরেশ্বর মজুমদার ছিলেন ধনী মধ্যস্বত্ত্বভোগী। অথচ সেই পরিবারেই চারু মজুমদারের জন্মটা যেন খানিকটা দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের মতো, অন্তত আজ সরকারিভাবে জমিদারি ব্যবস্থার অবলুপ্তির পর একথা বলাই চলে। ১৯৩৩ সালে শিলিগুড়ি বয়েজ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে ভর্তি হলেন পাবনা এডোয়ার্ড কলেজে। আর এমন সময়েই এল তেভাগা আন্দোলনের ঝড়। সেটা ১৯৩৬ সাল। মজার ব্যাপার হল, তেভাগা আন্দোলন শুধু হাড়-হাভাতে চাষাদের আন্দোলন হয়ে থাকল না। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চারু মজুমদার নিজেও। আর জলপাইগুড়ি জেলায় দায়িত্ব নিয়ে ফিরে এলেন।

চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর চিরস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। আরেক পার্টিকর্মী লীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে বিবাহ হল ১৯৫২ সালে। না, অন্দরমহলের বন্ধ দরজায় বিপ্লবের আগুন নিভে যায়নি। দুই মেয়ে এবং এক ছেলেকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার দুজনের। দুজনেরই তাতে সমান দায়িত্ব। কখনও পার্টির কাজে লীলা মজুমদার বাইরে থাকলে চারু বাবু মেয়েদের চুল আঁচড়ে দিয়েছেন। রান্না করে খেতে বসিয়েছেন। আবার দিনরাত গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ানোই যেখানে চারু মজুমদারের স্বভাব, সেখানে রোজগারের দায়িত্বও যে বেশিরভাগতাই লীলা মজুমদারের উপর এসে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। বোধহয় বিপ্লবীদের সংসারই এমন হয়।

তবে নকশালবাড়ির প্রাথমিক স্ফুলিঙ্গ যেমন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনটা কিন্তু বেশিদিন চলল না। কিছুদিনের মধ্যেই ভাঙন ধরল দলের অভ্যন্তরে। ইতিমধ্যে তিনটি ভাঙনের মধ্যে দিয়ে সিপিআইএমএলের জন্ম। তার মধ্যেও আবার ভাঙন? কিন্তু দলের প্রতিটা নেতৃত্বের পৃথক পৃথক পথ নানা দিকে ছুটে চলেছিল। কিন্তু চারু মজুমদারের ভূমিকা এখানে কেমন ছিল?

আরও পড়ুন
নকশাল আন্দোলন থেকে 'মহীনের ঘোড়াগুলি' - ঝড়ের আরেক নাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়

কমরেড কানু সান্যালের বক্তব্য কিন্তু এখানে বেশ অবাক করে। যে চারু মজুমদার বলেছিলেন তিনি নেতা নন, আন্দোলনের নেতা আসলে কানু সান্যাল; বদলে কানু সান্যাল কিন্তু বললেন দলের মধ্যে রীতিমতো ডিক্টেটরশিপ চালাতে থাকেন চারু মজুমদার। শুধু তাই নয়, লেনিন এবং স্তালিনের লেখা থেকে অজস্র উদ্ধৃতি আওড়ে গেলেও চারু মজুমদার নাকি আসলে বিপ্লবের কিছুই বোঝেন না, এমন অভিযোগও করেছিলেন কানু সান্যাল। তবে শেষ পর্যন্ত যে তিনি অনেকটা একা হয়ে পড়েছিলেন, সেকথা বলাই বাহুল্য। এর মধ্যেই আবার পুলিশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁর উদ্দেশ্যে। ৬৩ বছরের একজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষও নাকি একাই সমস্ত শাসনযন্ত্র বিকল করে দিতে পারেন। কোনরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছেন। এই সময় অবশ্য আরেক নেতা মহাদেব মুখার্জি নানাভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। দুজনের লাইন হুবহু না মিললেও বন্ধুত্বটা শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল।

১৯৭২। পার্টির নানা ভগ্নাংশ তখন নানাদিকে ছুটছে। কোনরকমে দলকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন চারু মজুমদার। কখনও কলকাতা তো কখনও ডুয়ার্সের অরণ্য -- শুধু পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াতেই নয়, পার্টিকে বাঁচাতেও তাঁর নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নেই। কিন্তু দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে তার লক্ষ কী হবে? চারু মজুমদার জানলেন, জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ। এই শেষ দলিলের কিছুদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তার হলেন পুলিশের হাতে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে পুলিশই যেন তাকিয়ে থাকল। এই সেই ত্রাস সঞ্চারকারী নেতা? চেহারায় তো তেমন কোনো ছাপ নেই। এমনকি বছর খানেক আগেও যাঁর নামে শয়ে শয়ে ছাত্র-যুব পথে নেমে পড়তে পারত, তাঁর গ্রেপ্তারির পরেও তেমন চাঞ্চল্য নেই কোথাও। আত্মীয়দের কাউকে দেখা করতে দেওয়া হল না চারু মজুমদারের সঙ্গে। এও যেন অতি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মেনে নিলেন সকলে। লক-আপে তাঁর উপর কতটা অত্যাচার চলেছে তার কোনো বর্ণনাই আর জানা যাবে না কোনোদিন।

এর মধ্যেই ১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই লালবাজার পুলিশ লক-আপ থেকে জানানো হল, মৃত্যু হয়েছে চারু মজুমদারের। মাত্র কয়েক মাসের বন্দিত্বেই মৃত্যু হল তাঁর? শরীর তো তেমন ভেঙে পড়েনি! বিস্মিত হলেন অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন করবেন কাকে? পুলিশ কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া দূরস্থান, মৃতের মুখ পর্যন্ত দেখতে দেননি কাউকে। কেবল সাংবাদিকদের অনুরোধে একবার সেই সুযোগ মিলল। আর সত্যম ঘোষ, গৌতম গুপ্তরা তাকিয়ে দেখলেন, মুখ বলে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। পুরোটা সাদা ব্যান্ডেজে ঢাকা। আদৌ লাশ চারু মজুমদারের কিনা, সে বিষয়েও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর স্ত্রী-সন্তান অবশ্য সেই মৃতদেহ দাহ করে ফিরে গিয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন
লকডাউনের মধ্যেই উদ্ধার লীলা মজুমদারের অপ্রকাশিত লেখা-চিঠি-ছবি

শোনা যায় দলের কেউ কেউ নাকি চারু মজুমদারের এই মৃত্যু মানতে চাননি। এমনকি কিছুদিন পরে মহাদেব মুখার্জির গোষ্ঠী লালবাজার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। তারও নাকি উদ্দেশ্য ছিল চারু মজুমদারকে সশরীরে উদ্ধার করা। অবশ্য স্বভাবরসিক মহাদেব মুখার্জি কোনোদিন স্পষ্টভাবে রহস্য ভাঙেননি। কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে এমনভাবে ঘাড় নাড়তেন, যার উত্তর হ্যাঁ-ও হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। সে-রহস্য কোনোদিন ঘুচবে কি? সম্ভবত না...

ঋণঃ চারু-মজুমদার-এবং-তাঁর-উত্তরাধিকার, সিপিআইএমএল কেন্দ্রীয় কমিটি

ব্যান্ডেজ-রহস্য অবশ্য রহস্যই থেকে গেল, গৌতম গুপ্ত, এইসময়

আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার

কানু সান্যালের ব্যাখ্যায় ডিক্টেটর ছিলেন চারু মজুমদার, আজকাল পত্রিকা

Powered by Froala Editor

More From Author See More