সময়টা ১৮৫৫ সাল। তখনও অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হননি নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। কলকাতার মেটিয়াবুরুজে ‘ছোটো লখনৌ’-এর জন্ম আরও বেশ কিছু বছর পরের ঘটনা। সেই ওয়াজেদ আলী শাহ যখন লখনৌ-এর মসনদে, তখনকারই গল্প এটি।
অযোধ্যা বিতর্কের গোড়াপত্তন মূলত নবাবি আমলেই। কিন্তু কী নিয়ে এই বিতর্ক? বর্তমানের আবহাওয়া হয়তো বলবে তা রামমন্দির ও বাবরি মসজিদকে নিয়ে, কিন্তু ইতিহাস সেই কথা বলে না। সর্বপল্লি গোপালের ‘অ্যানাটমি অফ আ কনফ্রনটেশন: অযোধ্যা, অ্যান্ড দ্য রাইস অফ কমিউনাল পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া’ বইটিতে সেই সময়ের বিতর্কের সেই অন্য গল্প শোনা যায়। জানা যায়, সে বিতর্ক আসলে একটি হনুমান মন্দিরকে কেন্দ্র করে।
নবাবি শাসনের আগে সেখানকার হিন্দু মন্দিরগুলোতে ভক্তদের ভিড় খুব একটা লক্ষ করা যেত না। কিন্তু ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই পরিস্থিতির কিছুটা বদল ঘটে। সেই সময় একধিক মুসলিম নবাবের অনুদানই ছিল হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। জানা যায়, অযোধ্যার সেই হনুমান মন্দিরের জমিটিও ছিল এক মুসলিম নবাবেরই দান। কিন্তু ১৮৫৫ সালে দেখা দেয় দাঙ্গা পরিস্থিতি। সুন্নি মৌলবি শাহ গুলাম হুসেন দাবি করেন, যে জমিতে হনুমান মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে একটি মসজিদ ছিল। যা ভেঙে হনুমান মন্দির তৈরি হয়েছে।
গুলাম হুসেন তাঁর ৫০০ জন অনুগামীদের নিয়ে ৮ হাজার বৈরাগীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। প্রথমে পরাজিত হলেও দমে যাননি তিনি। হামলা চালিয়ে যান ক্রমাগত। হিন্দু বৈরাগীদের মারতে শুরু করেন। এই ঘটনার ভয়াবহতায় ক্ষুব্ধ হন সম্প্রীতি-প্রিয় নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ। নিজে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও এ-ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেন। চেষ্টা চলে মীমাংসার। অবিলম্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন নবাব। শুরু হয় তদন্ত। তদন্তের রিপোর্ট ব্রিটিশ সরকারকে পাঠানোর নির্দেশও দেন ওয়াজেদই।
কমিটির তদন্তে উঠে আসে, হনুমান মন্দিরের জায়গায় কোনও মসজিদ কস্মিনকালেও ছিল না। ফলে গুলাম হোসেনের দাঙ্গার মূল ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। কমিটির তদন্ত অনুযায়ী হিন্দুদের পক্ষেই সমর্থন যায়। ফলে মুসলিমরা আবারও ক্ষেপে ওঠে। তখন নবাব ওয়াজেদ আলী পুনরায় যাতে ধর্মে-ধর্মে সংঘাত মুছে যায় তার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি পরিকল্পনা করেন, হনুমান মন্দির সংলগ্ন স্থানে একটি মসজিদ তৈরি করবেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। নবাবের পরিকল্পনায় মুসলিমরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন আরও। বাধ্য হয়েই এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন নবাব। কিন্তু হনুমান মন্দির নিয়ে সমস্যার ইতি হয়নি সেখানে।
যতই বিপরীত ধর্মাবলম্বী হন না কেন, তিনি ছিলেন প্রকৃতই শাসক। তাই তাঁর দায়িত্ব ছিল হনুমান মন্দিরকে রক্ষা করা। আর তিনি করেছিলেনও তাই। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে মুসলিম নবাব ওয়াজেদ আলী রক্ষা করেছিলেন হিন্দু মন্দিরকে। মাত্র চার বছরের নবাবিয়ানায় এই সবই লখনৌ-কে করে তুলেছিল তাঁর স্বপ্নের নগরী। আর তাই প্রাণাধিক প্রিয় লখনৌ ছেড়ে কলকাতা যাওয়ার সময় ‘যব ছোড় চলি লখনোয় নগরী’-র সুরে ও ভাষায় ফুটে উঠেছিল ওয়াজেদ আলী শাহের বেদনা। লখনৌ থাকাকালীন রাধাকৃষ্ণ-কে নিয়ে নাটক লিখেছেন তিনি, এ-কথাও কি ভুললে চলে!
তথ্যসূত্র -
১. "Ayodhya: When Wajid Ali Shah saved Hanuman temple from Muslims near Babri Masjid", Prabhash K Dutta, India Today.
২. "বিভাজন নয়, ভালবেসে ‘শাসন’ করতেন ওয়াজিদ", কুন্তক চট্টোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা।
৩. "অযোধ্যা বিতর্ক আসলে রামমন্দির নিয়ে নয়, সত্যিটা জানুন", আজকাল ওয়েব ডেস্ক।
৪. Anatomy of a Confrontation: Ayodhya and the Rise of Communal Politics in India, Sarvepalli Gopal
৫. "When a temple was besieged in Ayodhya", Manu S. Pillai, mint.
Powered by Froala Editor