মধ্য কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এক্সাইড মোড়। একদিকে রবীন্দ্রসদন-নন্দন, আর অন্যদিকে গোর্কি সদন-সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাসপাতাল ও সংস্থা। আবার উত্তরে একটুখানি গেলেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। এই মোড় থেকে একটু পশ্চিমে গেলেই পড়বে উডবার্ন পার্ক। আর তার প্রায় গা ঘেঁষে ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব। যাকে বলে একেবারে জমজমাট এলাকা…
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই জায়গাটি নিয়ে এত বাক্যব্যয় কেন! সঙ্গত প্রশ্নই বটে। তবে এর উত্তরের খোঁজে একটু ফিরে যেতে হবে ঔপনিবেশিক কলকাতার আমলে। তখনকার ম্যাপ খুঁটিয়ে দেখলে এই বিশেষ জায়গাটির ‘বিশেষত্ব’ বেশ ভালো বোঝা যাবে। আজকের উডবার্ন পার্ক, ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব-সংলগ্ন ওই বিস্তীর্ণ জায়গা দেখলে কে বলবে, একটা সময় ওখানেই ছিল একটি কবরস্থান। কাসিয়াবাগান গোরস্থান। ইংরেজদের নয়, মুসলিমদের। তাও যে সে কবরস্থান নয়; স্বয়ং নবাবেরা, এবং তাঁদের পরিবারের লোকেরা সেখানে ঘুমোচ্ছেন। এমন একটি জায়গা বেমালুম হারিয়ে গেল চিরকালের জন্য। সেইসঙ্গে হারিয়ে গেল এক দুর্ভাগা নবাবের কাহিনি…
আঠেরো শতকের শেষের সময়। আওয়াধের সিংহাসনে বসে আছেন নবাব আসাফ-উদ-দৌলা। নিঃসন্তান তিনি; চিন্তায় আছেন উত্তরাধিকারকে নিয়ে। এমন সময়ই তাঁর বোনের ছেলেকে দত্তক নিলেন নবাব। এই ছেলেই হবে ভবিষ্যতের নবাব। সেজন্য সবরকমভাবে তৈরিও করা হল। নাম হল ওয়াজির আলি খান। এমনকি, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে লখনউতে বিয়েশাদিও দিলেন দত্তর পুত্রের। হাজার হোক, আওয়াধের উত্তরসূরি বলে কথা!
খুব বেশিদিন গেল না। কয়েক বছরের মধ্যেই দেহ রাখলেন আসাফ-উদ-দৌলা। ১৭৯৭ সাল। সিংহাসনে বসলেন নবাব ওয়াজির আলি খান। মনে রাখতে হবে, ততদিনে ঘটে গেছে পলাশির যুদ্ধ। ব্রিটিশদের হাতে একটু একটু করে বাড়ছে ক্ষমতা। সৈন্য-সামন্তও বাড়ছে। দেশীয় রাজা-নবাবদের অভিষেকে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা উপস্থিত থাকতেন। এখানেও তাঁর অন্যথা হল না। নবাব ওয়াজির আলি খানকে সাদরে বরণ করে নিলেন ইংরেজরা। হায় রে ইতিহাস! তখনও কেউ ভাবতেই পারল না, কয়েক মাস পরেই পরিস্থিতি কোনদিকে ঘুরবে…
আরও পড়ুন
কোথায় হারিয়ে গেল রামপুর নবাবদের কোটি কোটি টাকার গুপ্তধন? আজও জাল কাটেনি রহস্যের
ওয়াজির আলি খান একজন নবাব। আওয়াধে তাঁর পূর্বপুরুষেরা শাসন করে গেছেন। তাঁর পালকপিতাও দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছেন এখানে। এই নবাবি সিংহাসনের একটা মর্যাদা আছে, দেশের একটা ঐতিহ্য আছে। এই সাদা চামড়ার বিদেশিরা এসব কী করে বুঝবে? শুরুর দিন থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে লাগলেন ওয়াজির আলি খান। কথায় কথায় তাঁদের বিরুদ্ধে যেতে লাগলেন তিনি। প্রথমে ইংরেজরা শান্তভাবে মেনে নিলেও, পরে দেখল এ তো মহা গণ্ডগোল! তাহলে তো এই নবাব তো আমাদের বশে আসবে না! কয়েক বছর আগেই বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাও একই কাজ করছিলেন। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এঁর বিরুদ্ধেও তা-ই নেওয়া হোক…
সময় থাকতে থাকতে এই নবাবকে সিংহাসন থেকে সরাতে হবে। আর ব্রিটিশদের এই চক্রান্তে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন দ্বিতীয় সাদাত আলি খান। সম্পর্কে ইনি ছিলেন ওয়াজির আলি খানের কাকা। মসনদের দিকে নজর তো বরাবরই ছিল তাঁর। সুযোগ বুঝে ইংরেজদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন তিনি। স্যার জন শোরের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী এসে পৌঁছল আওয়াধ। ১৭৯৮ সালেই সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হল নবাব ওয়াজির আলি খানকে। ইংরেজদের ‘পুতুল’ হয়ে মসনদে বসলেন দ্বিতীয় সাদাত আলি খান।
আরও পড়ুন
পাকিস্তানের পতাকা উড়ল হাজারদুয়ারিতে, অসহায় সাক্ষী মুর্শিদাবাদের ‘নখদন্তহীন’ নবাব
বাধ্য হয়ে এসব মেনে নিতে হয়েছিল ওয়াজির-কে। কিন্তু শান্ত থাকার পাত্র নন তিনি। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পাঠিয়ে দিল বেনারসে। সেখানকার রেসিডেন্ট জর্জ ফ্রেডরিক চেরীই ঠিক করবেন, এরপর কী হবে প্রাক্তন নবাবের। নবাব গেলেন বটে; তবে একা নয়। সঙ্গে রইল বিরাট বাহিনী। এমন ভাব দেখালেন, যেন একাই গিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু আসল মতলব যে ছিল অন্য!
১৭৯৯ সাল। বেনারসের ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জর্জ চেরী অপেক্ষা করছেন ওয়াজির আলি খানের জন্য। এমন সময় খবর পেলেন, তিনি এসেছেন। বাইরে গেলেন; এবং যা দেখলেন তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন না। ওয়াজির তো এসেছেনই; সেইসঙ্গে এসেছে তাঁর বিশাল সেনা। বেশিক্ষণ লাগল না দরবারের সবাইকে শেষ করতে। ওয়াজিরের হাতেই বেঘোরে মারা গেলেন চেরী সাহেব। এরপরই সেনাদের মধ্যে যেন রক্ত ফুটে উঠল। ওয়াজির আলি খানের নেতৃত্বে সবাই রওনা দিলেন তৎকালীন বেনারসের ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েল ডেভিসের বাড়ির দিকে। স্রেফ একটি বর্শা দিয়ে তাঁদের ঠেকিয়ে রাখলেন ডেভিস সাহেব। বেগতিক বুঝে সৈন্য নিয়ে পালিয়ে গেলেন ওয়াজির আলি খান। কিন্তু বেশিদিন পারলেন না লুকোতে। ধরা পড়ে গেলেন ইংরেজদের হাতে…
আরও পড়ুন
কলকাতায় নির্বাসিত ওয়াজেদ আলি শাহ, নবাবি শখেই তিলোত্তমা পেল ঘুড়ির উত্তেজনা
এবার শুরু হবে গল্পের আসল অংশ। লখনউ, বেনারস থেকে কাহিনি এসে পৌঁছল কলকাতায়। তখন এই শহর ব্রিটিশদের রাজধানী। এর আগেই ব্রিটিশরা দেখেছেন সিরাজের রাজত্ব। কাজেই ওয়াজিরের সময়ও কোনরকম ঝুঁকি নিলেন না। এখন আর তিনি নবাব নন; প্রাক্তন নবাবের সম্মানও পেলেন না। বন্দি ওয়াজিরকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল ফোর্ট উইলিয়ামে। অন্ধকার, ছোট্ট একটি লোহার খাঁচার ভেতর বন্দি করা হল তাঁকে। কোনরকম সম্মানের ধার ধারল না ইংরেজরা। ওয়াজির আলি খানকে একটু একটু করে শেষ করার পরিকল্পনাই ছিল তাঁদের। আওয়াধের আসল নবাব বসে আছেন বন্দিশালায়; তাঁর অবস্থা কহতব্য নয়। খাবার জলটুকুও পেতেন না ঠিকমতো। এতটাই রাগ ইংরেজদের…
সেই অবস্থাতেই ১৭ বছর বন্দি ছিলেন আওয়াধের প্রাক্তন নবাব ওয়াজির আলি খান। কতদিন আর সহ্য করা যায় এমন অবস্থা! শেষমেশ ১৮১৭ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের সেই অন্ধকার কুঠুরির ভেতরেই মারা গেলেন তিনি। সবাই ভেবেছিল, শেষকৃত্যের সময় অন্তত সম্মান দেবে ইংরেজরা। না, এখানেও প্রায় কিছুই করল না ইংরেজরা। কর্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী, মাত্র সত্তর টাকায় সম্পূর্ণ হল শেষ যাত্রার কাজ। আর কবর? অবশিষ্ট মাত্র ১০ টাকা দিয়ে কাসিয়াবাগান কবরস্থানে তৈরি হল সেই অন্তিম শয্যা। যাকে বলে, করতে হয় বলে করা। যার বিয়েতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হল, তার কবর তৈরি হল মাত্র দশটি টাকায়! ভাগ্য কি একেই বলে!
আর আজ? কাসিয়াবাগান কবরস্থানের কোনো অস্তিত্বই নেই কলকাতায়। ম্যাপ খুললে কেবলই শূন্য। সেদিনের কাসিয়াবাগান মুসলিম গোরস্থানের ওপর আজ অনেকগুলো বাড়ি। অনেক প্রতিষ্ঠান। ঝাঁ চকচকে সব জিনিস। কিন্তু ইতিহাস? সেটা হারিয়েই গেছে চিরতরে। হয়তো মাটি খুঁড়লে মিলতেও পারে কিছু…
তথ্যসূত্র-
১) ‘শ্রীপান্থের কলকাতা’/ শ্রীপান্থ
২) ‘The invisible cemeteries of Kolkata, and where you can find them’, Deepanjan Ghosh, Scroll
Powered by Froala Editor