এমবিবিএস পড়েও করতে হবে আয়ুর্বেদ-হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিস! ক্ষুব্ধ চিকিৎসকমহল

এমবিবিএস পাশ করা শিক্ষার্থীদেরও প্র্যাকটিস করতে হবে আয়ুর্বেদ, ইউনানি কিংবা হোমিওপ্যাথির মতো বিষয়। সম্প্রতি এমনই নির্দেশিকা জারি করল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন তথা এনএমসি। এমবিবিএসের চার বছরের পাঠক্রমের পর আরও এক বছরের ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক থাকে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। সেই পর্যায়েই তাঁদের আয়ুর্বেদ কিংবা হোমিওপ্যাথির এক সপ্তাহের বিশেষ প্র্যাকটিস করতে হবে জানাল মেডিক্যাল কমিশন। আর কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তেই ক্ষুব্ধ চিকিৎসকমহল।

বিগত কয়েক বছর ধরেই ‘মিশ্র চিকিৎসা পদ্ধতি’ কিংবা ‘মিক্সোপ্যাথি’-র প্রচলনে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। অ্যালোপ্যাথি বা প্রচলিত চিকিৎসাধারার সঙ্গে আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও হোমিওপ্যাথির সংযোগ সাধনের চেষ্টা চলছে অনবরত। তা নিয়ে অবশ্য প্রথম থেকেই প্রতিবাদে সরব হয়েছিল সর্বভারতীয় চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়াশন, আইএমএ। তবে তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করেই এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল মেডিক্যাল কমিশন।

“অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসার কোনো প্রমাণিত ভিত্তি নেই। এটা বৈজ্ঞানিক একটি পদ্ধতি। এই তিনটে পদ্ধতিকে এক জায়গায় আনারই চেষ্টা করে চলেছে কেন্দ্র। পাঠক্রমের দিকে দেখতে গেলে এমবিবিএসের সঙ্গে অন্য দুটি চিকিৎসাশাস্ত্রের শুরুতে প্রভূত মিল থাকে। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, ডায়াটমি-র ক্ষেত্রে একই বই পড়ানো হয় সমস্ত ছাত্রকে। অর্থাৎ, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতিটা একই থাকে। কিন্তু চিকিৎসা তো প্রায়োগিক বিদ্যা। সেই জায়গাটাতেই অ্যালোপ্যাথির থেকে আলাদা হয়ে যায় অন্যান্য পাঠক্রম। সেখানে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এক প্রকার এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে”, জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাঙালি চিকিৎসক।

চিকিৎসার এই মিশ্রনীতি যে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে চলেছে সে ব্যাপারেই সতর্ক করলেন তিনি। বর্তমানে কেন্দ্র সরকারি বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে একইসঙ্গে রয়েছে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসার পরিকাঠামো। এতদিন নিজেদের পছন্দ বিকল্প বেছে নেওয়ার সুবিধা পেতেন রোগীরা। তবে মিশ্রনীতি আরোপিত হলে, একজন হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসকও অনুমতি পাবেন অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ব্যবহারের। আর সেখানেই থেকে যাচ্ছে ভুল ওষুধ প্রয়োগের আশঙ্কা। এমবিবিএস ইন্টার্নশিপে আয়ুর্বেদ প্র্যাকটিস বাধ্যতামূলক করে সেই পথটাই যেন আরও খানিকটা প্রশস্ত করল কেন্দ্র।

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের নিয়েই প্যারালিম্পিকের পরিকল্পনা, আয়োজনে এক চিকিৎসক!

এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্টার্নের কথাতেও ফুটে উঠল সেই কথাই। “আমরা সাড়ে চার বছরের পাঠক্রমে ১৯টি বিষয় পড়ে তারপর যে চিকিৎসা করছি, ১ বছরের মিক্স কোর্স পড়ে সেই চিকিৎসা করাটা সম্ভব নয়। একইভাবে প্র্যাকটিসে কোনো এমবিবিএস চিকিৎসককে আয়ুর্বেদের চিকিৎসা করতে বলাটাও অযৌক্তিক। কারণ, এই চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপারে আমরা বিন্দুমাত্রও অবগত নই। ফলত, প্রতিটা চিকিৎসাবিদ্যা পৃথক থাকাই দরকার।”

আরও পড়ুন
সরকারের উদ্যোগেই ৩ লক্ষ শিশু চুরি স্পেনে, যুক্ত ছিলেন চিকিৎসকরাও!

সেইসঙ্গে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়েও রয়েছে দীর্ঘদিনের বিতর্ক। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রচলিত ওষুধ বাতিল হয়ে, শুরু হচ্ছে নতুন ওষুধের ব্যবহার। সেখানে দাঁড়িয়ে আজও অপরিবর্তিতভাবেই প্রয়োগ হয়ে চলেছে হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদের মতো চিকিৎসা-পদ্ধতিগুলি। তাতে নিঃসন্দেহে কিছু গুণাবলি রয়েছে, কিন্তু দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তা কতটা কার্যকরী, সে ব্যাপারেই উঠছে প্রশ্ন।

আরও পড়ুন
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় বিপ্লব এনে বিশ্বসেরা এসএসকেএম-এর ডাঃ সুজয় ঘোষ

চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠক্রমের এই হঠাৎ পরিবর্তন আগামীতে প্রভাব ফেলতে চলেছে ছাত্রমহলেও, সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করলেন সরকারি হাসপাতালের আরও এক চিকিৎসক। জানালেন, “ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এই মিশ্রনীতি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে। ফলত, উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের একটা বড়ো অংশ বিদেশে চলে যাবে পড়াশোনা করতে। ইদানিং এমনিতেই সেই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। সরকারের সিদ্ধান্ত সেই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।” বিশেষভাবে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন চিকিৎসার এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিটের দিকে, “একটু ভালোভাবে দেখলেই বোঝা যাবে নিটের র্যা ঙ্কিং-এ প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীরা সকলেই এমবিবিএসকে বেছে নেয়। বদলে একটু পিছনের সারির শিক্ষার্থীরা সুযোগ না পেলে তবেই আয়ুর্বেদ কিংবা হোমিওপ্যাথিকে পাঠ্য করে। সেদিক দিয়ে দেখলে মেধাবী ছাত্রদের বিদেশে চলে যাওয়া, ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও দুর্বল করে দেবে আগামী দিনে।”

তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ক্রমাগত প্রতিবাদ চলবে বলেই জানাচ্ছেন আইএমএ-র চিকিৎসকরা। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে সেই প্রতিবাদ অবস্থান। মিশ্রনীতি বর্জন করে আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়নে যাতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়, সেই দাবিতেই সরব তাঁরা। এখন দেখার পাল্টা কী প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের তরফে…

Powered by Froala Editor