১৮৮৮ সাল। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির এক বৈঠকে গবেষণাধর্মী বিশেষ একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছলেন টেলিফোনের আবিষ্কর্তা স্যার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-সহ ৩৩ জন বিজ্ঞানী, গবেষক এবং অনুসন্ধিৎসুরা। সে-বছর সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই পত্রিকা। ৯৮ পৃষ্ঠার সেই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ৬টি বিশেষ গবেষণা এবং তাদের মূল্যায়ন। তবে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকেনি এই পত্রিকা। বরং, কালক্রমে তার মধ্যে জুড়ে যায় পরিবেশ, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিক।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন (National Geographic Magazine)। প্রাথমিকভাবে কেবলমাত্র বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করেই প্রকাশিত হলেও, ধীরে ধীরে সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল এই পত্রিকা। পরিণত হয়েছিল কাল্টে। এবার ছাঁটাই করা হল এই পত্রিকার শেষ কয়েকজন স্টাফ লেখক এবং সম্পাদকদেরও। ফলস্বরূপ, বন্ধ হতে চলেছে ১৩৫ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই পত্রিকা।
অবশ্য ‘ন্যাট জিও’-র এই পদক্ষেপ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। গত ৯ মাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কর্মীছাঁটাই-এর পথে হাঁটল শতাব্দীপ্রাচীন পত্রিকাটি। আরও ভালো করে বলতে গেলে ২০১৫ সাল থেকে হিসাব করলে, এটি তাদের চতুর্থ কর্মীছাঁটাই-এর সিদ্ধান্ত। কিন্তু হঠাৎ কেন এই পথে হাঁটতে হল জনপ্রিয় এই পত্রিকাকে?
প্রশ্নের উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে একশো বছর। ১৯০৫ সালে গবেষণা পত্রিকা থেকে প্রথাগত প্রকাশনা বা পত্রিকায় পরিণত হয়েছিল ‘ন্যাট জিও’। সংবাদজগতের কথায় বলতে গেলে ‘ইয়েলো বর্ডার’ অতিক্রম করে এই ম্যাগাজিন হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন। সে-বছর থেকেই এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল বিভিন্ন ফটোগ্রাফ। যার ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের মধ্যেও বাড়তে থাকে এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে এই পত্রিকার গ্রাহকের সংখ্যা পৌঁছায় ১০ লক্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়া এই পত্রিকা হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। ’৮০-র দশকে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এই পত্রিকার গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ। তাছাড়া বিদেশেও বিক্রি হত কয়েক লক্ষ কপি। ‘ন্যাট জিও’-র সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে এই পত্রিকায় গ্রাহকের সংখ্যা পৌঁছেছিল প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এতকিছুর পরেও সেভাবে লাভের মুখ দেখছিল না এই পত্রিকা। তাই ব্যয় কমাতেই এই সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের। অবশ্য এই ‘কর্তৃপক্ষ’ বলতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি নয় মোটেই। আসলে একুশ শতকেরও শুরুর দিক পর্যন্ত এই পত্রিকার মালিকানা ছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির কাছেই। ২০১৫ সালে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পত্রিকার মালিকানা কিনে নেয় ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স’। ক্ষমতায় আসার পরেই প্রাথমিকভাবে কর্মী ছাঁটাই করেছিল এই বহুজাতিক সংস্থাটি। পরবর্তীতে পত্রিকার যৌথ মালিকানায় জুড়ে যায় ওয়াল্ট ডিজনির নামও। বর্তমানে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’-এর সম্পূর্ণ স্বত্ব রয়েছে তাদের কাছেই।
একুশ শতকে এই পত্রিকার ছাপা সংস্করণের পাশাপাশি প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ডিজিটাল সংস্করণ। তাছাড়াও ‘ন্যাট জিও ওয়াইল্ড’ এবং ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’-খ্যাত দুটি পৃথক পৃথক টেলিভিশন চ্যানেলও ছিল এই পত্রিকাটির। সাম্প্রতিক সময়ে সার্বিকভাবে ডিজিটাল সংস্করণ, টেলিভিশন এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকেই ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ। কমছে পত্রিকার গুরুত্ব। ফলে গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, কমেছে লভ্যাংশের হার। আর সেই কারণেই ধাপে ধাপে কর্মীছাঁটাই-এর সিদ্ধান্ত ডিজনির।
গত এপ্রিল মাসেই কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অবশিষ্ট ১৯ জন সম্পাদক এবং লেখককে জানানো হয়েছিল, কয়েক মাসের মধ্যেই কর্মীছাঁটাই-এর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে পত্রিকা। বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেই কথা ঘোষণা করে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয় ন্যাট জিও পত্রিকার অডিও বিভাগটিও। বর্তমানে ফ্রিলান্সার লেখকদের দিয়েই লেখানো হবে এই পত্রিকার প্রবন্ধগুলি। তাছাড়া বিকল্প পদ্ধতিতে অন্যভাবে লেখা ও ছবি সংগ্রহের চেষ্টা করবেন পত্রিকার সম্পাদকরা। চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত চলবে এভাবেই। আগামী বছরের গোড়া থেকে আর ছাপা হবে না পত্রিকাটি। বন্ধ হবে বিক্রির আউটলেটও।
অবশ্য পত্রিকা বন্ধ হলেও, ‘ন্যাট জিও’-র নামটি মুছে যাচ্ছে না, এমনটাই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একাধিক কর্মী এবং সম্পাদকের থেকে। অনেকেরই অনুমান, আগামীতে ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এই পত্রিকা। তবে কিংবদন্তি এই পত্রিকা বন্ধের খবরে বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে বিশ্বব্যাপী পাঠকের মনকে। এখন দেখার নবরূপে এই পত্রিকা কীভাবে প্রত্যাবর্তন করে আবার…
Powered by Froala Editor