লোকসভা এবং রাজ্যসভা, দু'জায়গাতেই পাশ হয়েছে বহু বিতর্কিত কৃষি বিল। যদিও গণতন্ত্রের ধাত্রীভূমিতেই কতটা গণতান্ত্রিকভাবে এই বিল পাশ হল, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। বিল পাশ হওয়ার পরে অসন্তোষ ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। সরকার যতই এই বিল কৃষকদের সুবিধার জন্যই আনা হয়েছে বলে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, দেশজুড়ে বিক্ষোভের সুর কিন্তু অন্য কথাই বলছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই, কেন্দ্রের সমালোচনায় এবার কোমর বেঁধে পথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকেরাও।
কৃষিবিলের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর। তার মতে, এই বিল নিয়ে আসার কারণ হল ছোটো কৃষকদের উন্নতি সাধন। এবার থেকে ছোট কৃষকেরা সরাসরি তাদের ফসল নিজেরাই পছন্দসই দামে বিক্রি করতে পারবেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের যেমন হটানো যাবে এই বিলের ফলে, তেমনই চাষিকে আর নিজের ফসল নিয়ে ঘুরতে হবে না ক্রেতার জন্য। বরং ক্রেতারাই ফসল কিনতে আসবেন চাষির কাছে। ব্যবসায়ী এবং কৃষকদের মধ্যে দূরত্ব কমার ফলে কমবে পরিবহন খরচও। এর ফলে কৃষকদেরই সুবিধা হবে। উপরন্তু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য জারি থাকবে কৃষিপণ্যে, এমনও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
তাহলে কেন এই বিল নিয়ে এত বিতর্ক? এই প্রসঙ্গে কৃষক সংগঠনগুলির দাবি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। দেশের বেশিরভাগ কৃষক সংগঠনগুলির দাবি করেছেন, এই বিল কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী। কর্পোরেট সংস্থা ও বড়ো ব্যবসায়ীদের কৃষিক্ষেত্রে একচ্ছত্র রাজ করতে সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই এই বিল নিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়াও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি দাবি করতে শুরু করেছে, এই বিলের ফলে শুধু কৃষকেরাই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষেরাও। দেশের ফসল বিদেশে রপ্তানী হয়ে গেলে দেশের খাদ্যশস্যের ভাণ্ডারে টান পড়ার আশঙ্কাও থাকছে যে!
সরকারি যুক্তির উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে বলা হয়েছে, সরকার যেভাবে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, গম অথবা তৈলবীজকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রী মজুদের ঊর্ধ্বসীমা থেকে ছাড় দিয়েছে, তাতে অন্য একটা আশঙ্কা থাকছেই। সেটা হল, এই সব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ঘুরপথে চলে যেতে পারে বড়ো ব্যবসায়ীদের হাতে। এছাড়াও মজুতদার ও বড়ো ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে অনেক বেশি কৃষিজ পণ্য কিনলেও আদৌ তাঁরা বাজারের সর্বোচ্চ দাম দেবেন কিনা, তা নিয়েও কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং এর ফলে সরকার সহায়ক মূল্য প্রদান করার দায় নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও কৃষকদের সশক্তিকরণ ও সুরক্ষার জন্য যে বিল আনা হয়েছে, তার ফলে কৃষক নিজের জমিতেই ভবিষ্যতে ক্রীতদাস হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞেরা।
এই বিলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে দেশের প্রায় ২৫০টিরও বেশি কৃষক সংগঠন। উল্লেখযোগ্য, আরএসএস সমর্থিত কৃষক সংগঠন ভারত কিষান সংঘও বিরোধিতা করেছে কেন্দ্রের আনা এই কৃষি বিলের। অল ইন্ডিয়া কিষান ও ক্ষেতমজুর সংগঠন, কৃষক সংগ্রাম পরিষদের মতো সংস্থাগুলি একটি যুক্ত মঞ্চ গঠন করে দেশজুড়ে গ্রামীন ভারত বনধের ডাক দিয়েছে আজ, ২৫ সেপ্টেম্বর। কৃষিবিলকে সামনে রেখে কৃষকদের একজোট করার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বাম দলগুলিও। তৈরি করেছে সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মতো যৌথ মঞ্চ, যেখান থেকে নেওয়া হবে দেশজুড়ে অথবা রাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বেশ কিছুদিন পরে বিরোধীদের মরা গাঙে বান আসার একটা সুযোগ করে দিয়েছে এই বিল। মনে করিয়ে দিচ্ছে, বছর দুই আগের মহারাষ্ট্র সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের ‘লং মার্চ’ কর্মসূচি। প্রায় ১৮০ কিলোমিটার হেঁটে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কৃষকদের আন্দোলনের ছবি নিশ্চই ভুলে যাইনি আমরা এখনও অনেকেই। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের নীচের চামড়া খুলে গিয়েছে; তবুও রক্তাক্ত পা-গুলো হেঁটে চলেছে রাস্তার ধুলোয় লাল মিশিয়ে দিতে দিতে— দেশের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম ছবি হয়ে থেকে গিয়েছিল এই দৃশ্য। তাই কৃষক আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই আবার বিরোধীরা পথে নামলে জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে তা একটা উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন হতে চলেছে, তা বলাই যায়। কীভাবে বিরোধীদের এই ধাক্কা কেন্দ্রীয় সরকার সামলায়, সেটাও দেখার।
আরও পড়ুন
'অপরাধ' কৃষি বিলের প্রতিবাদ – রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কৃত ৮ সাংসদ, রয়েছেন বাংলার দুই প্রতিনিধিও
এছাড়াও কৃষিবিলের আরও কিছু বিষয় নিয়ে যথেষ্ট খটকার জায়গা রয়েছে। বিল অনুযায়ী, কৃষকরা যখন চুক্তি ভিত্তিক চাষে রাজি হবেন, তখন কোনও বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ী বা কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হলে, তার মীমাংসা কীভাবে হবে তার কোনও উল্লেখ নেই সেখানে। এছাড়াও এই বিবাদের নিরিখে সেই কৃষকের আইন-আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওই বিলে। এক্ষেত্রে বিবাদের মীমাংসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মহকুমা শাসক বা জেলা শাসকের হাতে।
তবে স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও কৃষিক্ষেত্র নিয়ে এই বিতর্ক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বছরের পর বছর ধরে কৃষকদের উন্নয়নের কথা বলা হয়ে এলেও আদতে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। ভারতীয় কৃষিকে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে কোনও পরিকল্পনাই নেওয়া হয়নি সেইভাবে। তাই কৃষিক্ষেত্রে অবশ্যই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার মানে এটা কখনোই নয় যে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির মতো কৃষিকেও বেসরকারিকরণ করে দিতে হবে! তাছাড়াও এই ক্ষেত্রটিও কর্পোরেটের হাতে চলে যাওয়া মানেই কর্পোরেট সংস্থা এখানেও সর্বোচ্চ লাভের কথাই ভাববে। তাই কৃষক নিজের ইচ্ছামতো জমিতে চাষ করতে পারবেন কিনা, সেটা নিয়ে একটা সন্দেহ কিন্তু থেকেই যায়। আর যদি সেই আশঙ্কা সত্যি হয়, তাহলে নিজের জমিতে কৃষককের পরিণতি হবে ক্রীতদাসের মতো। তাছাড়াও যদি ব্যাপক পরিমাণে প্রযুক্তি ব্যবহার হতে শুরু করে, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই কর্মহীন হয়ে পড়বেন বহু কৃষক।
তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বিলের প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমেছেন কৃষকেরা। হরিয়ানায়, উত্তরপ্রদেশে অথবা পাঞ্জাবের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছে কৃষকদের। এমনকি কৃষকদের বিক্ষোভ আটকাতে পুলিশদের কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহারও করতে হয়েছে কোথাও কোথাও। তবু নিজেদের গরজেই পায়ে হেঁটে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন হরিয়ানার কৃষকেরা। তবে যেভাবে কৃষকেরা এই কৃষি বিলকে তাদের ‘মৃত্যুপরোয়ানা’ বলে মনে করছেন, তাতে সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের এবার জোটবদ্ধ হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। কৃষি বিলের সমস্ত দিকগুলি খতিয়ে না দেখে তাই কেন্দ্রীয় সরকার তাড়াহুড়ো করে এই বিল পাশ না করালেই বোধ হয় তা যথার্থ সিদ্ধান্ত হত। সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি উঠলেও, বিরোধীদের সেই দাবিও নস্যাৎ করে দিয়ে কেন্দ্র নিজের অহঙ্কারেরই নিদর্শন রেখেছে।
আরও পড়ুন
কৃষিক্ষেত্রেও ‘বেসরকারিকরণ’? কৃষি সংশোধনী বিল নিয়ে বিতর্ক চরমে
একটা কথা কিছুতেই কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, পেটে টান লাগলে শিরা টানটান হয়ে ওঠে সকলেরই। তাই এই ঘটনা আগামী দিনে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য হতে চলেছে ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রের জন্যই। কৃষকদের স্বার্থ বিঘ্নিত না করেই তাদের সত্যিকারে উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা হবে, এই আশা দেখেছিল সমস্ত সাধারণ ভারতবাসীই। কিন্তু উন্নয়নের নামে যদি আবার নীলচাষিদের সময়ে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয় কৃষকদেরকে, তাহলে কৃষকদের সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সাধারন জনসাধারণের জন্যেও অত্যন্ত দুঃসময় আসতে চলেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেই ভবিষ্যতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার, সেটাই কাম্য।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে নারাজ অর্থ মন্ত্রক; ভালো ফলনের পরেও বঞ্চিত কৃষকরা