করোনা আবহে এক ধাক্কায় লাফিয়ে বেড়েছে মানব পাচার। কিন্তু এই পাচার প্রতিরোধে কি পর্যাপ্ত প্রতিরক্ষাকর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে? ঘাটতি থাকলেও বা তা কতটা? এবার এই প্রশ্নের উত্তর উঠে এল কলকাতার একটি এনজিও ‘সংযোগ’ এবং আইনজীবীদের, মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজকর্মীদের সংস্থা ‘তফতিশ’-এর যৌথ রিপোর্টে। এই দুই সংস্থাই ভারতের ৩৩টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনের কাছে দ্বারস্থ হয়েছিল পাচারচক্রের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। যার মধ্যে উত্তর মিলেছে মাত্র ২২টি রাজ্যের থেকে। সেখান থেকে তাঁরা সংগ্রহ করেন গত ১০ বছরের মানব-পাচারের তথ্য।
রিপোর্টে উঠে আসে যে সমস্ত রাজ্যের থেকে উত্তর পাওয়া যায়, সেই সব রাজ্যের মোট ৩৮৩টি জেলার মধ্যে ৩২২টি জেলাতে অনুপস্থিত অ্যান্টি ইউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট। তবে এই ৩২২টি জেলার মধ্যে ৭১ শতাংশে অর্থাৎ ২২৫টি জেলায় খাতায় কলমে রয়েছে এই পাচার প্রতিরোধ বিভাগ। কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই কোনো।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কাজের লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করা হয় মানুষকে। শিকার হয় বিশেষত শিশুরা। এই কাজের বিষয়ে অনেক সময়ই অবগত থাকেন তার পরিবারের লোকজনও। তারপর এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে গেলে বোঝা যায় জালিয়াতির ছক। এছাড়াও অপহরণ, যৌন নিগ্রহের মত ঘটনা তো রয়েছেই।
দুই সংস্থারই কর্মকর্তাদের মতে, মানবপাচার এমনই একটি অপরাধ যাকে চিহ্নিত করতে গেলে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীর দরকার পড়ে। রয়েছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবও। বা থাকলেও তা ধারাবাহিক নয়। একমাত্র বিহারের ক্ষেত্রেই এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে পুলিশি বিভাগ।
আরও পড়ুন
সম্মানজনক কাজ নেই; ড্রাগ পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহিলারা
অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিটের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। পাচারচক্রের মামলা নথিভুক্ত করা থেকে শুরু করে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ, তদন্ত, উদ্ধারকার্য এবং চক্রীদের বিচার। সবটাই নির্ভরশীল এই প্রতিরক্ষাকর্মীদের ওপরে। একটি পাচারচক্রকে আয়ত্তে আনার জন্য দরকার পড়ে এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়ের। যেখানে বড়-সড় ঘাটতি রয়েছে দেশে। সাধারণ থানায় পাচারের অভিযোগ দায়ের করলেও, সেই অভিযোগ পারতপক্ষে নথিভুক্ত হওয়ার কথা অ্যান্টি ইউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিটের খাতায়। থানার পুলিশকর্তাদেরই দায়িত্ব থাকে এই মামলা হস্তান্তরের। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ বাহিনীর অনুপস্থিতিতে সাধারণ পুলিশকেই বাড়তি কাজ হিসাবে পাচারচক্রের তদন্তকারীর ভূমিকাও পালন করতে হয়। কিংবা সাধারণ পুলিশকর্মীদের নিয়েই গঠিত হয় এই ইউনিট।
আরও পড়ুন
লকডাউনের মধ্যেই চলছে পাচার, মেক্সিকোয় উদ্ধার ১৫০০ বিরল প্রজাতির কাছিম
সাধারণ থানায় অভিযোগ দায়ের করাতে গিয়েও অনেক সময় ভুল থেকে যায় পুলিশকর্তাদের নথিকরণে। ওই দুই সংস্থা জানাচ্ছে, পাচারের বিষয়ে ডায়েরি নেওয়া হলেও অনেক সময়ই তা কেবলমাত্র পকসো আইনের আওতায় রাখা হয়। লাগু করা হয় না আইপিসি কিংবা আইটিপিএ-এর আইন। যা একরকম বোঝাপড়া কিংবা প্রশিক্ষণেরই অভাব বলেই মনে করছেন সংস্থার বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
পাচারের মুখ থেকে ফিরে আসা মহিলাদের খাদ্যদ্রব্য দিয়ে সাহায্য, মানবিক উদ্যোগ বাসন্তীতে
রিপোর্ট উঠে আসে কেবলমাত্র বিহার, কেরালা, নাগাল্যান্ড, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং উত্তরাখণ্ডের প্রত্যেকটি জেলাতেই রয়েছে এই ইউনিট। ঝাড়খন্ড এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ৩০ শতাংশ জেলায় এবং ছত্তিশগড়ের ২৫ শতাংশ জেলায় উপস্থিত এই বিশেষ বাহিনী। তবে শুধু ঝাড়খন্ড, মিজোরাম এবং উত্তরপ্রদেশেই এই ইউনিটগুলির কর্মীদের উপর কোনো বাড়তি দায়িত্ব থাকে না।
তবে ভাবলে একটু অবাকই লাগবে, পাচার প্রতিরোধকারী এই ইউনিটগুলি তৈরির জন্য বহু বছর আগে থেকেই নোটিস দিয়েছে সরকার। এমনকি গত জুন মাসেই প্রত্যেক রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে এই পরিষেবা বাড়ানোর জন্য লিখিতভাবেই জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই ইউনিট গঠনের জন্য নির্ভয়া ফান্ডে বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। অথচ পুরো পরিকল্পনাই থমকে আছে প্রায় সারা দেশেই। বাজেটের দিক দিয়ে দেখতে গেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তহবিল তৈরি করলেও অধিকাংশ রাজ্যেই গঠিত হয়নি এমন বিশেষ তহবিল। কারণ খুঁজতে গিয়েই উঠে আসছে সরকারি ঘোষণা সত্ত্বেও রাজ্যগুলিতে এই ইউনিটের গঠন বাধ্যবাধক করেনি কেন্দ্র। বিশেষ আইনি ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি এই ইউনিটগুলিকে। পাশাপাশিই এর সঙ্গে যোগ নেই রাজনৈতিক স্বার্থেরও। সে-কারণেই কি এই ইচ্ছাশক্তির অভাব? জানা নেই...
Powered by Froala Editor