সাহস করে সত্যজিৎকে চিঠি লিখতে পারেননি নাসিরুদ্দিন

১৯৭১ সাল। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’য় চলছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ম্যাকমুলার ভবনে সেদিন বড়ো পর্দায় দেখানো হচ্ছে কিংবদন্তি পরিচালক বার্গম্যানের ছবি ‘সাইলেন্স’। অথচ কিছুতেই যেন সেই সিনেমায় মনোনিবেশ করতে পারছেন না তিনি। বরং, শিহরিত হয়ে আছেন অন্য একটি কারণে। তাঁর ঠিক সামনের আসনেই যে বসে রয়েছেন আরেক বিশ্ববরেণ্য পরিচালক। সত্যজিৎ রায়। তাঁর সঙ্গে কীভাবে কথা বলা যায়, সেই চিন্তাই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে বছর বাইশের তরুণ শিক্ষার্থীর মনে।

সেদিনের সেই তরুণ শিক্ষার্থী আর কেউ নন, তিনি নাসিরুদ্দিন শাহ। তাঁর পরিচয় আলাদা করে দেওয়া বাতুলতাই বটে। থিয়েটারের মঞ্চই হোক কিংবা সেলুলয়েড স্ক্রিন— অভিনয়কে তিনি নিয়ে গেছেন এক অন্য পর্যায়ে। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের উপহার দিয়েছেন ‘আক্রোশ’, ‘নিশান্ত’, ‘মির্চ মশালা’, ‘ইশকিয়া’, ‘ত্রিকাল’, ‘ডার্টি পিকচার’-এর মতো সিনেমা। আজ বাহাত্তরে পা দিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা। কিন্তু অভিনয় জীবনের প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে আসার পরেও এখনও তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকে আক্ষেপের সুর। খ্যাতি, সম্মাননা, প্রশংসা সবকিছু পেলেও সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করার সুযোগটাই যে ব্রাত্য থেকে গেছে তাঁর কাছে!

বয়স তখন মাত্র বারো বছর। প্রথমবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখে শিহরিত হয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। বেড়ে গিয়েছিল অভিনয়ের খিদে। কিশোরবেলা থেকেই সত্যজিতের ছবিতে নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। ছাত্রাবস্থায় সামনাসামনি সত্যজিৎকে পেয়েও আর সেই আবদার রাখা হয়নি রাশভারি মানুষটার সামনে। পরে একাধিকবার তিনি ভেবেওছেন সত্যজিৎকে চিঠি লিখবেন অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করে। তবে সে সাহস হয়নি। 

তবে শুধু সত্যজিৎই নন, চলচ্চিত্র জগতের আরেক বাঙালি তারকার অন্ধভক্ত ছিলেন নাসিরুদ্দিন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের ছবিতে সৌমিত্রের অভিনয় মুগ্ধ করেছিল তরুণ নাসিরুদ্দিনকে। দিল্লিতে ‘সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা’ দেওয়ার সময় সৌমিত্রের সঙ্গে একই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছেও প্রকাশ করে বসেছিলেন তিনি। সেই সুযোগ আসে অশীতিপর বাঙালি অভিনেতার চলে যাওয়ার বছর দেড়েক আগে। শৈবাল মিত্রের ছবি ‘দেবতার গ্রাস’। সহ-অভিনেতা হিসাবে নাসিরুদ্দিনকে পেয়ে খুশিও হয়েছিলেন সৌমিত্র।

আরও পড়ুন
আত্মপ্রকাশ সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে; প্রয়াত কার্টুনিস্ট ও পরিচালক গৌতম বেনেগাল

২০১৯ সালের মে মাস সেটা। কলকাতায় তখন কাঠফাটা গরম। তার মধ্যেই শুটিং হয়েছিল ‘দেবতার গ্রাস’-এর। শুটিং চলাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সৌমিত্র। আর নাসিরুদ্দিন? ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন সৌমিত্রকে তরতাজা রাখতে। কখনও আড্ডায় মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁকে, আবার ক্লান্ত সৌমিত্রকে কখনও নানাভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন বাড়তি শট। 

আরও পড়ুন
গুণমুগ্ধ ছিলেন সত্যজিৎ-উত্তমের, অভিনয়ের তাগিদে শিখেছেন বাংলা ভাষাও

সৌমিত্রের সঙ্গে তাঁর অভিনয়— সেই প্রথম, সেই শেষ। কিংবদন্তি অভিনেতার চলে যাওয়ার পর বেশ আক্ষেপের সুরেই সে-কথা জানিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। অবশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বহু প্রাচীন। প্রায় চার দশক আগে ১৯৮৩ সালে তাঁর অভিষেক হয়েছিল বাংলা সিনেমায়। প্রথমবারের জন্য তিনি অভিনয় করেছিলেন প্রভাত রায় পরিচালিত ‘প্রতিদান’ বাংলা চলচ্চিত্রে। কলকাতাতে আসা সেই প্রথম। তবে যে কলকাতায় আসার স্বপ্ন দেখতেন তিনি ছোটো থেকে, তাকে দেখে খানিকটা হতাশই হয়েছিলেন তিনি। মহানগরীজুড়ে তখন কাজ চলছে মেট্রোরেলের। চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা। অগোছালো শহরটা ততটা মনে ধরেনি তাঁর। কিন্তু যত দিন গেছে, ততই কলকাতাকে ভালোবেসে ফেলেছেন নাসিরুদ্দিন। কলকাতার আন্তরিকতায় মজে অভিনয় করেছেন একাধিক সাম্প্রতিক বাংলা চলচ্চিত্রে। আর বাঙালি দর্শক? তাঁদের থেকেও কি কম ভালোবাসা পেয়েছেন ‘দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টলম্যান’?

আরও পড়ুন
রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় ইরফানের, যে বাঙালির কাছে আজও কৃতজ্ঞ জাপানিরা

তথ্যসূত্রঃ
১. ওঁকে আমি হিংসে করতাম, নাসিরুদ্দিন শাহ, আনন্দবাজার
২. উইকিপিডিয়া
৩. Naseeruddin Shah says he regrets not having worked with Satyajit Ray, Indian Express
৪. ‘মূর্খদের মতামত দেওয়ার জায়গা হল সোশ্যাল মিডিয়া’, সাক্ষাৎকার, আনন্দবাজার

Powered by Froala Editor

More From Author See More