বরফ-ঢাকা স্বর্গের রাস্তা, মৃত মেমের পুলওভার আর ‘মধুসূদন দাদা’-র গপ্প

‘দেশে বিদেশে’-তে সর্দারজি যখন চুল বাঁধতে, দাড়ি সাজাতে আর পাগড়ি পাকাতে আরম্ভ করলেন, তখনই সৈয়দ মুজতবা আলী বুঝতে পারলেন যে পেশওয়ার আসতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। মুশকিল হল, আমরা এমন কোনও ইঙ্গিতও পাচ্ছিলাম না। এদিকে শেষ ডিসেম্বরের কনকনে শীত। তার ওপর, রাস্তার দু’পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তাই হারিয়ে ফেলেছি বলা যায়। তারমধ্যে, কদাচিৎ কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, প্রত্যেকেই বলছেন নারকান্ডা আসতে ‘এক ঘণ্টা অউর।’ এই ‘এক ঘণ্টা’-র চক্করে পড়ে গাড়ি ছুটছিল অন্তত ঘণ্টা দুই-তিন ধরে।

সাধারণত সবাই শিমলা হয়ে নারকান্ডা আসেন। রাস্তা কম। কিন্তু আমরা ঠিক করেছিলাম, মানালি ঘুরে আসব। তাহলে জলৌরি পাস ছুঁয়ে আসা যাবে। বরফ পাব। ড্রাইভারজি বারণ করেছিলেন। রাস্তা বন্ধ থাকার ভয় দেখিয়েছিলেন। আমরা শুনিনি। বন্ধ থাকলে থাকবে, অ্যাডভেঞ্চার হবে বেশ। জলৌরি পাসের বেশ খানিক আগে থেকেই বরফে মোড়া রাস্তা শুরু হল। দু’পাশে আদিম হিমালয়। ঘোর লেগে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য।

কিন্তু, কিছুক্ষণের মধ্যেই মোহভঙ্গ হল। বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ। এদিকে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। শুনতে পাচ্ছি, নারকান্ডা সোজা পথেই অন্তত ৫৫ কিমি। বাঁকা পথে অন্তত দেড়গুণ বাড়বে রাস্তা। অমিতাভ গুগল ম্যাপ দেখে রাস্তা খুঁজছে, ড্রাইভারজি স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে। হঠাৎ গাড়িটা ডানদিকে বেঁকে গেল। সেই রাস্তা গুগল ম্যাপে নেই। দু’দিকে পাহাড়, একটা নদীর পাশ দিয়ে অন্ধকার রাস্তা। তখনও বেশ ভালো লাগছিল। আহা, এটাই তো আসল হিমালয়।

এবারেও মোহভঙ্গ হল। ক্লান্তি, খিদে, শীত, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’- মার্কা ভয়। মাঝে রাস্তায় দেখলাম, দূরের পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। একবার মনে হল, দাবানল। কেউ একটা বলল, ওটা ফসল পোড়ানো হচ্ছে। অতঃপর রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ নারকান্ডা এল। দ্রুত মালপত্তর ঘরে ঢুকিয়ে তবে শান্তি। শীত যেন অস্থি-মজ্জাও কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

সকাল হতেই সব ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। ৮,৮৮৫ ফুট উঁচু নারকান্ডা শীতকালে যাকে বলে অলীক। পাইন, ওক, ম্যাপল, হেজেলনাট, পপলার গাছে ঢাকা। কয়েকটা দোকান, হোটেল নিয়ে একটা ছোট্ট টাউন। হিমালয়ের ব্যালকনি। সামনেই একটা স্কি করার ঢালু জমি। শীতে পুরু বরফের চাদরে মোড়া থাকে এই মাঠ। পর্যটকদের ঠাসা ভিড় নেই বলেই হয়ত নারকান্ডাকে খুব আপন লাগে। যে-কদিন ছিলাম, তাপমাত্রা রাতে নেমে যাচ্ছিল মাইনাস ৩-৪ ডিগ্রিতে। দিনের বেলায় রোদ উঠলে দূরে ঝকঝক করে উঠছিল বরফ ঢাকা শৃঙ্গগুলো। আকাশ যেন নীল সোয়েটার গায়ে দিয়েছে। হোটেল চত্বরেই রকমারি ফুল। হোটেলের সামনে লন। লনের ওপারে খাদ। দূরে উপত্যকা। আহ…

নারকান্ডার আসল আকর্ষণ অবশ্য হাটু পিক। টাউন থেকে ৮ কিমি দূরে ১১, ১৫৫ ফুট উঁচুতে এই পিকে উঠতে হয় পায়ে হেঁটে। খানিকটা গাড়ি যায়। তারপর, রাস্তা জুড়ে বরফ। একটা ছোট্ট লেক বরফে জমে গেছে। তার ওপরে দিব্বি হাঁটা যাচ্ছে, স্কি করা যাচ্ছে। চারপাশে উঁচু উঁচু আদ্যিকালের দাদামশাই সব গাছ। মাঝখানে সরু রাস্তা। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। এই রাস্তাই সোজা গিয়ে উঠেছে হাটু পিকে। খুব খাড়াই নয়। কিন্তু একটা বাঁক নিতেই দেখি, গোটা রাস্তাটা বরফে সাদা। কোথায় রাস্তা শেষ হয়ে খাদ শুরু হয়েছে, সেটাও বোঝার জো নেই। শুরুতেই ছন্দপতন হল। আমার এক বান্ধবী পিচ্ছিল বরফে পা পিছলে মুখ থুবড়ে পড়ল। বুঝলাম, আমাদের ভাগ্যেও এইসব নাচছে।

ওঠার সময় অবশ্য খুব বেশি বিপদ হয়নি। এক-একটা বাঁকে হিমালয় নতুন নতুন পোস্টকার্ড বের করছিল। হাটু পিকের মাথায় মন্দির। মন্দিরের সিঁড়িতেও বরফ। জলের ট্যাঙ্কের পাশে কলের জল বরফ হয়ে মাটিতে নেমে আটকে আছে। মন্দিরের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে কোথায় যেন একটা। এখানে, একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু অন্ধকার নামার আগেই নিচে নামতে হবে। ভয়ঙ্কর একটা রাস্তা অপেক্ষা করছে। অতএব, নামা শুরু হল।

নামার শুরু এবং সেইসঙ্গে আছাড় খাওয়ারও শুরু। প্রথমে হাসাহাসিই করছিলাম নিজেরা। কিন্তু অচিরেই হাসিতে আতঙ্ক মিশতে লাগল। বাপ রে, কী বিপজ্জনক রাস্তা। দু’পা এগোতে না এগোতেই ধপাস। কোমরে চোটের আর কে ভাবে তখন! একবার মনে হল, বসে পড়ি। তারপর স্লিপ খেয়ে নামি। সেই চেষ্টা সফল হল না। রাস্তা মসৃণ নয়। অনিচ্ছে সত্ত্বেও ফের উঠে দাঁড়ালাম। পাশে একজন বন্ধুবর নিজের সমস্ত ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে চন্দ্রবিন্দু-সমেত হহু হাহা করছেন। নিজেকে প্রবোধ দিতেই আমি ‘মধুসূদন দাদা’-কে ডাকতে আরম্ভ করলাম। ‘হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো মধুসূদন দাদা’। যদি এই মজাতে পথের আতঙ্ক খানিক কমে। কিছুক্ষণ পরে নিজেরই মনে হল, মজাটা নিছক মজা থাকছে না, গভীর বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপারটা বাজে হচ্ছে বুঝে চুপ করলাম। কিন্তু কিছু তো একটা চাই। গান, অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ আর্তনাদ ইত্যাদি নানাকিছুর পরে অবশেষে বরফ শেষ হল। উফ, এত আনন্দ কোনওদিন পাইনি।

না, ভুল বললাম, প্রায় একইরকম আনন্দ পেয়েছিলাম পরেরদিন নারকান্ডা বাজারে। ফুটপাথের ধারে একজন রাশি রাশি জ্যাকেট, কারডিগান, পুলওভার নিয়ে বসেছিলেন। দামি-দামি সব জিনিস। সাহেব-মেম-বড়লোকদের। হয় তারা ইহজগৎ ছেড়ে পাততাড়ি গুটিয়েছেন, নয়ত কোনও একভাবে এঁদের হাতে চলে এসেছে। দাম অবিশ্বাস্য কম। মৃত মেমের পুলওভার গায়ে চাপাতে আমার কোনও ভয় নেই। খুব বেশি হলে, মেমের আত্মা ভর করবে। সে করুক না! অতএব, কিনে ফেললাম। মোটে শ’তিনেক টাকা দাম। বাজারে এই জিনিস হাজারে তিনেকের কমে পাওয়া মুশকিল। বড় দাঁও যে সন্দেহ নেই।

নারকান্ডার ঘোর ভুলতে সময় লাগা স্বাভাবিক। কলকাতায় ফিরে কাজের চাপে হয়ত ভুলেও যেতে পারতাম। কিন্তু ওই কোমরের ব্যথা রাত-বিরেতেও হাটু পিকের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। সে এক রাস্তা বটে! তবে তারপরই মনে পড়ে, ম্যাপল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে আসা রোদ, দিগন্তে তুষারাবৃত হিমালয়… স্বর্গের রাস্তা তো কঠিনই হয়, কী বলেন!

Latest News See More