প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ, পৃথিবীর সুদৃশ্যতম সংবিধান এঁকে দিলেন নন্দলাল বসু

আবারও চলে এল আরও একটি ২৬ জানুয়ারি। স্বাধীন ভারতের ‘সাবালক’ হওয়ার দিন। দেশের তাবড় নেতা, মন্ত্রীরা মিলে তৈরি করেছিল আমাদের সংবিধান। পাতার পর পাতা হাতে লেখা কাগজে তৈরি হয় দেশের মেরুদণ্ড। শুধু কি লেখা? সংবিধানকে আকর্ষণীয় করার জন্য সেখানে ছিল অপূর্ব ছবি, নকশা। এই কাজ যিনি নিপুণ হাতে করেছিলেন, তাঁর কথা প্রজাতন্ত্র দিবসের জাঁকজমকের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। হ্যাঁ, ২৬ জানুয়ারি মানে সংবিধান, এবং সেই সঙ্গে নন্দলাল বসুও। তাঁর ছোঁয়াতেই প্রাণ পেয়েছিল এই বইটি।

তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে ভারত। তোড়জোড় চলছে সংবিধানের। ধীরে ধীরে তাকে রূপ দেওয়ার কাজ করছেন বি. আর. আম্বেদকর। কিন্তু তৈরি করলেই তো হবে না। সেটাকে তো লিখতেও হবে। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মাথায় ঘুরছে নানা পরিকল্পনা। ভারতের সনাতন রূপ যেন ফুটে ওঠে আসল সংবিধানের পাতায়। সেই সঙ্গে থাকুক আধুনিকতার ছোঁয়া। হাতে লেখার জন্য ক্যালিগ্রাফারকেও পেয়ে গেলেন তিনি। প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা।

কিন্তু আর কী করা যায়? সেই সময়ই নেহরুর মাথায় আসে ছবির কথা। ভারতের সনাতন ঐতিহ্যকে বজায় রেখে পুঁথির মতো সম্পূর্ণটা হাতেই তৈরি করতে চান তিনি। কিন্তু সেই মতো আঁকবেন কে? এর উত্তর খুঁজতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি তাঁর। নন্দলাল বসুকেই এই দায়িত্বটি দিতে চাইলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাব গেল তাঁর কাছে।

নন্দলাল বসু সেই সময় শান্তিনিকেতনে ছিলেন। নেহরুর প্রস্তাবে সাড়া দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই লেগে পড়লেন কাজে। সঙ্গ দিলেন কলাভবনেরই তাঁর কয়েকজন ছাত্র। তাঁর আঁকা ছবিতেই সেজে উঠতে লাগল সংবিধানের পাতা। উল্লেখ্য, এই পুরো কাজে তিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেছিলেন।

মোট ২২টি ছবি এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু। এই সবকটি ছবির মূল বিষয়ই ছিল ভারতের সংস্কৃতি। পুরাণ থেকে ইতিহাস— সমস্ত কিছুই ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর তুলি। সেখানে যেমন ছিল রামায়ণ-মহাভারতের ঘটনা, তেমনই ছিল সিন্ধু সভ্যতা, বুদ্ধ, মুঘল শাসন, এবং অবশ্যই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিবৃত্তও। অশোক, সম্রাট আকবর, টিপু সুলতান, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু— এঁরা সবাই সংবিধানের অংশ হয়ে থেকেছেন। প্রথমে ছবি, তারপর ইংরেজি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা সংবিধান—এইভাবেই অপূর্ব হয়ে উঠেছিল ভারতের হাতে লেখা আসল সংবিধান। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি, দেরাদুনে সংবিধান প্রকাশ করা হয়। তার ঠিক দুদিন পর, সংবিধান প্রয়োগ করা হয় দেশ জুড়ে। স্বাধীন ভারত হয়ে উঠল সাধারণতন্ত্র।

তবে এখানেই শেষ নয়। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কারগুলির এমব্লেমের নকশাও এঁকেছিলেন স্বয়ং নন্দলাল বসু। তার মধ্যে আছে ভারত রত্ন থেকে শুরু করে পদ্মশ্রী। হ্যাঁ। আজ যে পুরস্কারগুলো আমরা খবরের কাগজে, টিভিতে দেখতে পাই, সেগুলোর স্রষ্টা তিনিই। নিজেও পেয়েছিলেন পদ্মবিভূষণ সম্মান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও, হরিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য পোস্টার তৈরি করেছিলেন তিনি। গান্ধীজির বিখ্যাত ডান্ডি মার্চেরও ছবি এঁকেছিলেন তিনি। আজ সংসদ গ্রন্থাগারে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা আছে সেই হাতে লেখা, হাতে আঁকা সংবিধান। কিন্তু ২৬ জানুয়ারির এই বিশেষ দিনে, নন্দলাল বসু’র কথা সেরকম উঠে আসে না। কুচকাওয়াজ দেখে আপ্লুত হই, টিভিতে দিনভর চলা দেশাত্মবোধক সিনেমা দেখেও রক্ত গরম হয়। তার মধ্যেই কিছুক্ষণ কি আমরা স্মরণ করতে পারি না নন্দলাল বসু ও তাঁর কলাভবনের ছাত্রদের?

ঋণস্বীকার-
১) কলকাতা ২৪X৭, ‘ফেল করা ছাত্রের হাতেই সেজে উঠেছিল ভারতের সংবিধান’
২) The Hindu, 2016, ‘Bringing out the kala’
৩) The Print, 2018, ‘Celebrating Nandalal Bose, artist who rejected everything British & designed India’s constitution’
৪) WikiPedia

Powered by Froala Editor