পাওয়া যায় অভিযাত্রীদের ‘মাথা কাটা’ দেহ, আজও রহস্যে ঘেরা নাহানি উপত্যকা

সময়টা ১৯০৪, কি ১৯০৫। দুই ভাই উইলি ও ফ্রাঙ্ক পাড়ি জমালেন নাহানি উপত্যকার (Nahanni Valley) উদ্দেশ্যে। ঘন সবুজ অরণ্যে ঘেরা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কানে আসে পাহাড়ি ঝরনার শব্দ। কিছু প্রাচীন উপজাতি ছাড়া নেই আর কোনো মানুষের বসবাস। শোনা যায়, কানাডার এই সুন্দর উপত্যকায় নাকি সোনার খনি আছে। অবশ্য আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারেননি কেউ। ভাগ্যের পরীক্ষায় চললেন দুই ভাই। কিন্তু তারপর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তাঁদের। তিন বছর তন্নতন্ন করে খোঁজার পর মেলে মৃতদেহ। তবে পুরো দেহটি নেই। কে বা কারা যেন কেটে নিয়ে গেছে মাথা দুটি।

বন্য প্রাণী? কোনো উপজাতির আক্রমণ? নাকি কোনো পুরনো শত্রু অপেক্ষা করেছিল তাঁদের জন্য? কিছুদিন পরে লোকে ভুলে যায় এই ঘটনা। ১৯১০ নাগাদ নরওয়ের মার্টিন নামের এক ব্যক্তি যান নাহানি উপত্যকার গভীরে। প্রায় পাঁচ বছর পরে পাওয়া গেল তাঁর দেহ। এবারও পাওয়া গেল না মাথাটি। পরবর্তী সময়ে নিখোঁজ হন আরও অনেকেই। তাঁদের মধ্যেকার মিলটা আর বলার দরকার নেই নিশ্চয়ই।

নাহানি ভ্যালির নাম হয়ে গেল ‘ভ্যালি অফ হেডলেস মেন’ (Valley of Headless Men)। আজও সমাধান হয়নি এই রহস্যের। অথচ অদ্ভুত শান্ত এক পাহাড়ি উপত্যকা পর্যটকদের মুগ্ধ করতে বাধ্য। আছে ভার্জিনিয়া ফলসের অপরূপ দৃশ্য। ইউনেসকো এ কে ঘোষণা করেছে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ রূপে। অভিযাত্রীদের ভিড়ও কম হয় না। কিন্তু সে-সবই নাহানি-র বাইরের অংশে। গভীর অরণ্যের বহু অঞ্চল রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। পৈশাচিক মৃত্যভয়ে অভিযানে যায় না আর কেউ।

‘নাহানি’ শব্দের অর্থ নাহা উপজাতির নদীর পারের দেশ। কয়েকশো বছর ধরে ‘নাহা’-দের বাস ছিল এখানে। ‘ছিল’ বলার কারণ, নাহাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অভিযাত্রীদের মাথা কাটা যাওয়ার ঘটনা শুরু হতেই প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায় তারা। কী হল তাদের? কেউ জানে না। কারোর মতে, তাদের সম্পূর্ণ গোষ্ঠীর মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু পাওয়া যায়নি কোনো দেহ। তাহলে হয়তো পালিয়েছে ভয়ে। কিংবা তারাই অজানা কোনো অঞ্চলে লুকিয়ে চালিয়েছে গুপ্তহত্যা।

আরও পড়ুন
ইউরোপের বিভিন্ন জলাজমিতে ছড়িয়ে অসংখ্য মৃতদেহ, আজও অমীমাংসিত ‘বগ বডি’-দের রহস্য!

যদিও ‘ডেনে’ উপজাতিদের মতে নাহা-রা সবচেয়ে সাহসী। তারা ভয় পেত এই দুরন্ত যোদ্ধাদের। পাহাড়ের উঁচু অংশ থেকে নাহা-রা রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে চালাত আক্রমণ। শত্রু হলেও তাদের উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে আশঙ্কায় ‘ডেনে’-রাও। তাদের ধারণা কোনো অলৌকিক শক্তি ঘুরে বেড়ায় নাহানি-র গহীন অরণ্যে। মানুষের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে এক রহস্যময় সভ্যতাকে।

আরও পড়ুন
আদতে ভিনগ্রহী ছিলেন হিমালয়ের রহস্যময় ‘দ্রোপা’ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা?

কারণ আছে এই বিশ্বাসের। ওই অঞ্চলের লোককথাতেও ছড়িয়ে রয়েছে কিছু আশ্চর্য বর্ণনা। নাহানি-র গভীরে নাকি আজও প্রমাণ পাওয়া যাবে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার। আরেকটি জনপ্রিয় বিশ্বাস যে, পৃথিবীর গভীরে রয়েছে আরেক পৃথিবী। যাকে বলা হয় ‘হলো আর্থ’। উপত্যকার কোনো এক পার্বত্য গুহা ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। সঙ্গে আছে সোনার গুজবও। সেই সব কারণেই বারবার অভিযাত্রী দল হানা দিয়েছে নাহানি-তে। 

কিন্তু প্রত্যেকবারই পাওয়া গেছে মস্তকহীন দেহ। প্রাচীন সভ্যতার থেকেও বেশি রহস্যজনক এই হত্যাকাণ্ড। কানাডা সরকার থেকে তদন্ত করা হলেও সমাধান মেলেনি। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মধ্যে মিশে গেছে সমস্ত রহস্য। কী হয়েছিল উইলি, ফ্রাঙ্ক বা মার্টিনদের সঙ্গে? নাহা-রাই বা গেল কোথায়? উত্তর খোঁজেনি আর কেউ। একা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নাহানি-কে।

Powered by Froala Editor