উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। কলকাতা শহরে তখন খেলা শব্দটা যে চিত্রকল্পে আসত, তা আজকের মতো নয় একেবারেই। অনেকে বলেন ‘শরীর সংস্কৃতি’, অর্থাৎ ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই ভারতবর্ষ তথা বাংলায় খেলা বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূলত শরীরচর্চা ও তাকে সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরা। উত্তর কলকাতার অলিতে-গলিতে তখন কুস্তির আখড়া ছিল জনপ্রিয়। গৌড়হরি মুখুজ্জের হাত ধরে বেশ বড়ো বড়ো আখড়া গড়ে উঠেছিল আহিরীটোলা, শোভাবাজার অঞ্চলে। প্রিয়নাথ বোস আসার আগে থেকেই সার্কাস জনপ্রিয় হচ্ছে একটু একটু করে। উঠে আসছে জিমন্যাস্টিক। এছাড়া যোগাভ্যাস, ভারোত্তলন, হাডুডু, শতরঞ্জ, পাশা, ডাণ্ডাগুলি চলত পুরোদমে। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ছত্রছায়ায় থাকা ভারতবর্ষে এই শরীর শিক্ষা আন্দোলন যে ইংরেজদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ বা ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তা ক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকে উনিশ শতকের শেষভাগে। খেলার একমুখী প্রদর্শনকে প্রতিদ্বন্দ্বীতার রূপ দেওয়ার জন্য দরকার ছিল বিলিতি বুটে পা গলিয়ে ব্রিটিশদের সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে নামা। এই পরিসরটুকু গড়ে বাঙালি জাতিকে এক বৃহত্তর আন্দোলনের দ্বার যে মানুষটি খুলে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা ফুটবলের জনক, সব খেলার সেরা হয়ে ওঠা ফুটবলে বাঙালির কিক-অফের প্রাণপুরুষ নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
১৮৭৭ সাল। ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে বিশাল কালো গাড়িখানা যাচ্ছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। কলকাতার বিখ্যাত সর্বাধিকারী পরিবারের গিন্নিমা হেমলতা দেবী তাঁর পঞ্চম পুত্র নগেনকে নিয়ে বেরিয়েছেন গঙ্গাস্নানে। সেই সময়ে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’-এর মাঠে সাহেব-সেনারা বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে দেখে বছর আটের ছেলেটি গাড়ি থামাতে বলে। হেমলতা দেবীর বারণ সত্ত্বেও সে এগিয়ে যায় খেলা দেখতে। হঠাৎ বলটি একেবারে তার সামনেই। গোরা সৈন্যদের দেখেও ভয় না-পাওয়া ছেলেটি নিবিষ্ট হয়ে বলটা দেখছিল। সে সময়ে ব্রিটিশ সেনাদের বিশাল চেহারা দেখে তাদের ধারপাশও মারানোর সাহস পেত না সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তরা। কিন্তু এ ছেলের কাণ্ড দেখে একটু অবাকই হল ব্রিটিশ সেনারা। ইংরেজদের এক জন বলে ওঠে, ‘কিক ইট!’ হাত থেকে নামিয়ে পায়ে মেরে বলটা ফেরত পাঠায় ছেলেটি। বাঙালির পায়ে সে-ই প্রথম ফুটবল শট। সেদিনের আট বছরের ছেলেটিই নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
সেই সময়ে ব্রিটিশরা সেনাদলের বিনোদনের জন্য ক্রিকেট-ফুটবল কিংবা উত্তর ভারতে পোলো খেলা নিয়ে এলেও ভারতীয়দের সেই খেলায় শিক্ষিত হবার কোনো সুযোগ করে দিতেন না। হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় বিষয়টা লক্ষ করেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। কিন্তু বিষয়টা মেনে নেওয়া ঐ বয়সেই কঠিন হয়ে পড়ল নগেন্দ্রনাথের কাছে। গঙ্গাস্নান থেকে ফেরার পরেরদিনই স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের জোগাড় করে একটি দল গঠন করলেন তিনি। চৌরঙ্গীর ম্যান্টন এন্ড কোম্পানির দোকান থেকে ফুটবল ভেবে কিনে নিয়ে চলে এলেন একটি সাদা রাগবি বল। পরেরদিনই স্কুল প্রাঙ্গনে যখন নগেন্দ্রপ্রসাদ ও তাঁর দলবল বলটি নিয়ে খেলা শুরু করেন, তখন রীতিমতো ভিড় জমে যায় কলেজ স্ট্রিট চত্বরে। এই সময়ে প্রেসিডেন্সির ব্রিটিশ অধ্যাপক জি এ স্ট্যাক বিষয়টি দেখে নগেন্দ্রদের ডেকে বোঝান যে তারা যা করতে চাইছে তা ফুটবল হচ্ছে না। কিন্তু ছেলেদের উৎসাহ দেখে তিনি কিছুটা উদ্যম নিয়েই কিনে আনেন একটি ফুটবল এবং নিজে খেলা শিখিয়ে, উৎসাহী ছাত্রদের নিয়ে হেয়ার স্কুলে একটি ফুটবল টিম গড়ে তোলেন। অল্পদিনের মধ্যেই এই দল বেশ সুন্দরভাবে ফুটবল খেলাটা রপ্ত করে ফেলে।
স্কুলজীবন থেকেই নগেন্দ্রপ্রসাদের দুর্দান্ত নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা আর অদম্য জেদ বেশ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল কলকাতার অভিজাত পরিবারমহলে। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হবার পর নগেন্দ্রপ্রসাদ স্থির করলেন যে এই ফুটবল খেলাটাকে তিনি সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেবেন। এর মধ্যেই কলেজে ফুটবল খেলার সুবাদে পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ফুটবল খেলতে শুরু করে ভারতীয় ছাত্ররা। কলেজে কলেজে গড়ে উঠতে শুরু করল ফুটবল টিম। এর মাঝেই নগেন্দ্রপ্রসাদ উপলব্ধি করলেন, ফুটবলের নাগরিকতাকে সমাজের ভেতর প্রত্যক্ষভাবে মিশিয়ে দিতে গেলে দরকার সংগঠন, সেই সংগঠন স্থাপন হতে পারে ক্লাব গঠনের মাধ্যমে। অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়ায় কলকাতার ক্ষমতাশীল মহলে ভালোয় খ্যাতি ছিল তরুণ নগেন্দ্রপ্রসাদের। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বয়েজ ক্লাব, ওয়েলিংটন ক্লাব, ফ্রেন্ডস ক্লাব ও প্রেসিডেন্সি ক্লাবের জনক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠীত করে ফেলেন তিনি। এই বয়েজ ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ‘মার্কুইজ অফ রিপন’। এই ক্লাবটিই সম্ভবত ভারতীয়দের তৈরি প্রথম ফুটবল সংগঠন। এছাড়া তাঁর তৈরি ওয়েলিংটন ক্লাবই সর্বপ্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে ময়দানে ব্রিটিশ ক্লাবগুলির পাশে তাঁবু ফেলে। ফ্রেন্ডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠালগ্নে বাংলায় যে ফুটবল কতখানি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ মেলে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বাগানে সাধারণ মানুষের বিপুল জমায়েতে।
এর মাঝে নগেন্দ্রপ্রসাদ আরেকটি কাজও করে যাচ্ছিলেন সমানতালে। তিনি হাওড়া, হুগলির বিভিন্ন বনেদি পরিবার ও জমিদারদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফুটবল খেলাটাকে ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার কাজটা শুরু করেছিলেন। হাওড়ার ঈশ্বরচন্দ্র কুণ্ডুর পরিবারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে তিনি গড়ে তোলেন ‘হাওড়া স্পোর্টিং’, চুঁচুড়া রাজবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে গড়ে তোলেন চুঁচুড়া স্পোর্টিং। খেলাটা যখন ক্রমশ কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে মফঃস্বলে, তখন নগেন্দ্রপ্রসাদের সামনে এসে দাঁড়াল এক বড়ো সমস্যা। সেই যুগের ভয়গকর শ্রেণী ও জাতপাতের বিভাজন রেখার করাল ছায়া নেমে এল ফুটবলে। ১৮৮৭ সালে ওয়েলিংটন ক্লাবে একজন নিচুজাতের সন্তানকে খেলতে নেওয়া হলে বেঁকে বসেন বহু সভ্য। কথাটা নগেন্দ্রপ্রসাদের কানে যেতেই তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একটি সভা করে সংকীর্ণতার বিপক্ষে জোরালো সওয়াল করেন, তিনি বলেন - “ আমি বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছি, বংশপরিচয় নিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করিনি। জাতপাত নিয়ে খেলার আসর আমি সাজাব না, তৈরি করব খেলোয়াড় জাত।”
নিমেষে নিজের তৈরি সংগঠন নিজেই ভেঙে দেন। ওয়েলিংটন, ফ্রেন্ডস, প্রেসিডেন্সি ও বয়েজ ক্লাবকে একত্রিত করে নিজের শ্বশুরবাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বিখ্যাত “শোভাবাজার ক্লাব” এবং সমস্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য ক্লাবের দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। ঐ সময়ে দাঁড়িয়ে নগেন্দ্রপ্রসাদ সমস্ত সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে ওয়েলিংটন ক্লাবে পার্সি, খ্রিস্টান এমনকি মুসলমানদেরও সদস্যপদ দিয়েছিলেন। এ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
আরও পড়ুন
স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান, বিস্মৃতির অতলে নীলিমা ঘোষ
শোভাবাজার ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশরা বুঝল, নগেন্দ্রপ্রসাদের এই জেদ বাংলায় একটা বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে। তাই তারা এবার শুরু করলেন এক নোংরা খেলা। সে সময়ে ট্রেডস কাপ আর আই এফ এ শিল্ডে যোগ্যতার জোরে খেলার সুযোগ পায় শোভাবাজার ক্লাব। কিন্তু ব্রিটিশরা জানায় কালা-আদমি(ব্ল্যাক-ইন্ডিয়ান)-দের সঙ্গে তারা গায়ে গা লাগিয়ে খেলতে নামবে না। কিন্তু নগেন্দ্রপ্রসাদও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি প্রতিবাদ করে বলেন- “এই নীচ মনোবৃত্তি ইংরেজরা দেখাচ্ছে, আর আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, খুব শীঘ্রই তাদের শেকহ্যান্ড করে আমাদের সঙ্গে খেলতে হবে...”
নগেন্দ্রপ্রসাদের জেদের কাছে হার মানল প্রবলপরাক্রমী ব্রিটিশরাজ। শোভাবাজার শুধু খেললই না, ১৮৯২ সালে তারা ট্রেডস কাপে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে ব্রিটিশ দল ইস্ট রেজিমেন্ট সারেকে হারিয়ে লিখে দিল নতুন ইতিহাস। আর থামানো গেল না বাঙালিকে, ফুটবল খেলাটা বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ল বাংলায়...
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল নগেন্দ্রপ্রসাদের। কথিত আছে ১৮৮০-এর দশকে স্বামীজি নিয়মিত নগেন্দ্রপ্রসাদের দলগুলির সঙ্গে ব্রিটিশ দলের লড়াই দেখতে আসতেন কলকাতা ময়দানে। আর খুব সম্ভবত এই প্রেক্ষিতেই স্বামীজি মন্তব্য করেন - “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌছানো সম্ভব।”
আরও পড়ুন
প্রয়াত বাংলাদেশের প্রথম বাঁ-হাতি স্পিনার রামচাঁদ গোয়ালা
১৮৯৭ সালে শোভাবাজার রাজবাটিতে এক অনুষ্ঠানে স্বামীজি নগেন্দ্রপ্রসাদকে দেখিয়ে বলেন- “ইংরেজদের কাছে সম্মান আদায় করিবার পদ্ধতি এই মানুষটি জানেন। ওর মতো মানুষ, ঐ রকম মরদ চাই আমাদের দেশে...”
নগেন্দ্রপ্রসাদের খেলোয়াড়ি জীবন প্রসঙ্গে মন্মথনাথ বসু একবার বলেছিলেন- “ইউরোপবাসীদের নগেন্দ্রপ্রসাদ খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে বাঙালিরা বুদ্ধিতে ও জ্ঞানে কোনো অংশেই তাদের চেয়ে কম যায় না। আর খেলার মাঠে যারা নগেনের কনু-এর গুঁতো খেয়েছে তাঁকে আর কিছু বোঝাবার দরকার হত না, ব্রিটিশদের তিনিই প্রথম হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেন যে বাঙালির খালিপায়ে লাথি বুটপরা লাথির চেয়ে অধিক শ্রেষ্ঠ।”
নিজের সমগ্র জীবনটাকেই একটা সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। শুধু তো খেলাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া নয়, তাঁর লড়াই ছিল সমাজের সংকীর্ণতা, ঔপনিবেশিকতার অন্ধকার ডিঙিয়ে এক নতুন আলোর পথে উঠে আসার লড়াই। ১৯৪৫ সালে আই এফ এ নগেন্দ্রপ্রসাদকে সম্মান জানাতে আই এফ এ শিল্ডের বিজয়ী-কে ‘নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্মারক শিল্ড’ দেওয়া হয়। রুপোর ঐ শিল্ডে খোদাই করা ছিল একটি অখণ্ড ভারতের মানচিত্র আর তার ভেতর থেকে বাংলা অঞ্চল থেকে এক বালক ফুটবল নিয়ে দৌড়ে আসছে। এই প্রতীকটির ভেতরেই হয়তো নগেন্দ্রপ্রসাদের সমস্ত জীবনটা খোদাই করা থাকল। বাঙালির ফুটবল জন্মের প্রায় দেড়শো বছরের ইতিহাসে মোহনবাগানের শিল্ড জয়, এশিয়াডে সোনা জয়, ইস্টবেঙ্গলের আশিয়ান জয়ের মতো মাইলস্টোনে যতবারই ফুটবল পায়ে নিয়ে বিশ্বে তিনরঙা পতাকাটা উড়েছে, ততবারই হয়তো জিতে গেছেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী, বাঙালির শ্রেষ্ঠ খেলার অদ্বিতীয় প্রাণপুরুষ...
আরও পড়ুন
ব্যাডমিন্টনে বিশ্ব র্যাঙ্কিং ৪, আমরা কি মনে রেখেছি মনোজ গুহ-কে?
Powered by Froala Editor