উত্তর-পূর্ব ভারত এবং উত্তর-পশ্চিম মায়ানমারে বৈচিত্রময় নাগা উপজাতি বসবাস। নাগাদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়। এই রহস্যময় নাগা উপজাতি দীর্ঘদিন ধরেই বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। নিজেদের সংস্কৃতি, প্রথা, ঐতিহ্যের রক্ষা করতে স্বতন্ত্র গ্রামীণ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এই উপজাতি।
নাগারা মূলত শান্ত এবং নিরীহ হলেও নাগাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রক্তাক্ত, সহিংস ইতিহাস। এর কারণ, নাগারা বাহ্যিক হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন না। ভারতের স্বাধীনতার পরপরই তাই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল নাগারা। দাবি ছিল স্বায়ত্বশাসনের। ১৯৬০ সালে সেই দাবিপূরণ করে ভারত সরকার। একইরকম ভাবে মায়ানমারেও নাগারাও স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র গ্রামীণ ব্যবস্থার অধিকার জানিয়ে এসেছেন দীর্ঘকাল ধরেই। ২০১৫ সালে অর্ধ-গণতন্ত্র স্থাপিত হয় মায়ানমারের নাগা উপজাতির জন্য। কিন্তু সম্প্রতি মায়ানমারের পাশ হওয়া নতুন আইনে, সক্রিয় হয়ে উঠছে ধামা চাপা পড়া পুরনো আগুন।
মায়ানমারের নতুন এই আইন পাশ হয়েছে মূলত আবাদযোগ্য জমির সংরক্ষণের জন্য। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঝুম চাষ। আর তাতেই ক্ষুব্ধ নাগা জনগোষ্ঠী। তাঁরা মনে করছেন তাঁদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে এই আইন। অবশ্য সরকারের সুস্পষ্ট ধারণা নাগাদের এই চাষাবাদ প্রথা বনভূমি ধ্বংসের কারণ।
নাগা অধিবাসীরা অবশ্য সরকারের এই দাবিকে মানতে চান না। ঝুম চাষকে কেন্দ্র করেই তাঁদের জীবন-জীবিকা। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাগাদের নানান উৎসবও। জানুয়ারি এবং ফ্রেবরুয়ারির শুরুর দিকে পরিষ্কার করা হয় বনভূমি এবং চাষের জমি। তারপর কাঠ এবং ফসলের অবশিষ্টাংশে আগুন ধরান নাগারা। পালিত হয় উৎসব। তবে এতে পরিবেশ ক্ষতি হয় বলে মানতে নারাজ আদিবাসীরা। বরং তাঁরা মনে করেন আবর্তিত এই পদ্ধতিতে উন্নত হয় জমির মান। জমিতে অ্যাসিডের পরিমাণও কমে যায় এতে। প্যাথোজেন আর পোকামাকড়ের উৎপাত হ্রাস পায়। কোনো জমিতে একবার আগুন লাগানোর পর দু’এক বছর চাষের জন্য উপযুক্ত থাকে জমি। তবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য যাতে বজায় থাকে সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থেকে, সমপরিমাণ বনভূমি রোপণ করা হয় অন্যত্র।
বনভূমি সংরক্ষণেও সরকারের হস্তক্ষেপ উত্তপ্ত করে তুলেছে নাগাদের। তবে নাগাল্যান্ডের আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, এই অঞ্চলের জমি এবং বনভূমির পৃথক পৃথক মালিকানা রয়েছে গোষ্ঠীর লোকেদেরই। বহিরাগতদের এই জমি বিক্রি করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ তাঁদের সমাজে। তবে সরকারি এই নতুন আইন তাঁদের থেকে জমি আরোহণ করছে। কার্যত উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে তাঁদের। এমনটাই মনে করে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন নাগা অধিবাসীরা।
বনভূমির অধিকার নিয়ে একটা লম্বা সময় ধরে খণ্ডযুদ্ধ চলেছে নাগাদের সঙ্গে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে। সামরিক শক্তির কথা না শুনলে হত্যা পর্যন্ত করা হত তাঁদের। বছর দুয়েক আগে ২০১৮ সালে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল মায়ানমার সরকার এবং নাগা সম্প্রদায়ের মধ্যে। সেই চুক্তিতেই বলা হয়েছিল বনসম্পদ ব্যবহার করতে পারবে উপজাতির মানুষরা। তবে এই চুক্তি সরকার-ঘেঁষা হলেও মেনে নিয়েছিলেন তাঁরা।
তবে এসবের মধ্যেই চলত অবৈধভাবে কাঠ সরবরাহ। পাইনকাঠ নির্মানের জন্য কেটে নিয়ে যাওয়া হত শহরে। মূল্যবান এই বৃক্ষগুলির রোপণে মূলত বিনিয়োগ করতেন আদিবাসীরাই। নতুন আইনে এখন তাঁদেরই উৎখাত করা হচ্ছে এই বনভূমির অধিকার থেকে। নতুন আইনের গঠনে একবারও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেনি সরকার। এমনটাই অভিযোগ জানিয়েছে নাগা উপজাতির মানুষেরা।
ইতিমধ্যেই ‘ল্যান্ড ইন আওয়ার হ্যান্ড’ এবং ‘মায়ানমার অ্যালায়েন্স ফর ট্রান্সপআরেন্সি অ্যাকাউন্টেবিইটি’ এই আইন প্রত্যাখানের জন্য সামিল হয়েছে আন্দোলনে। উপজাতি সংগঠনগুলি জানিয়েছে উন্নয়নে সায় আছে তাঁদেরও। কিন্তু তার জন্য বনভূমি অধিগ্রহণ কিংবা তাঁদের সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে রাজি হয় তাঁরা। তাঁর কাছে স্পষ্ট সরকারের উদ্দেশ্য। অদূর ভবিষ্যতে নগরায়ন এবং কর্পোরেট সংস্থার কাজে সরকার ব্যবহার করতে চায় এই জমি। আদিবাসীদের বিরোধ সেখানেই।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা সংস্থার বন-আইন উপদেষ্টামণ্ডলী মায়ানমার সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন এই উপজাতিদের নায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে। বনভূমির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁদের জীবন, জীবিকা এবং সংস্কৃতি। সরকারি আইনের অসামঞ্জস্যতা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে তাঁদের প্রচলিত যাপনকে। তবে এর উত্তরে নির্বিকার মায়ানমার সরকার।
অন্যদিকে উচ্ছেদের প্রহর গুনছেন জঙ্গলেই বেড়ে ওঠা মানুষগুলো। বছর কয়েক আগে সরকারের হস্তক্ষেপে চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছিল হরিণ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা। সেই স্মৃতিই বিভীষিকা তৈরি করছে তাঁদের মনে। তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে অধিগ্রহণের পরবর্তী সময়ে বনভূমি ধ্বংসের ভবিষ্যৎ। এই দুঃস্বপ্নই এখন কুরে কুরে খাচ্ছে নাগা উপজাতির মানুষগুলোকে…