এক টুকরো কাঠ। তার ওপরে নিপুণ কারুকার্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি মহিলার মুখের আদল। নাকে ঝুলছে লম্বা নথ। হাওয়ায় উড়ছে তার খোলা চুল। এক ঝটকায় দেখলে মনে হবে উড়ন্ত সেই চুল হয়তো বানানো হয়েছে লোহার তার দিয়ে। তবে কাছ থেকে দেখলেই সে ভুল ভেঙে যাবে। আসলে এই গোটা শিল্পটাই তৈরি হয়েছে একটি মাত্র অখণ্ড বাঁশের টুকরোকে খোদাই করে। আর যাকে লোহার তার বলে ভুল ভেবেছিলেন, তা আসলে বাঁশের শিকড়।
প্রতাপ হালদার। নদীয়া জেলার শান্তিপুরের এই শিল্পী মজে রয়েছেন এমনই অদ্ভুত এক শিল্পচর্চায়। বাঁশের মোথা অর্থাৎ, গোড়ার অংশটি দিয়েই বিভিন্ন মূর্তি নির্মাণ করে চলেছেন তিনি। কখনও তার মধ্যে ফুটে উঠছে চাপ দাড়িওয়ালা পুরুষালি অবয়ব, আবার কখনও তা হয়ে যাচ্ছে মাছের শরীর। বাংলায় কাঠ কিংবা মাটির বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখা যায় হামেশাই। কিন্তু এমন অভিনব উপাদানের মধ্যে দিয়ে ভাস্কর্য, এককথায় বিরল।
“এটি মূলত চিনের একটি শিল্প। ত্রিপুরাতেও বাঁশের মোথার ওপরে এই ধরণের কাজ হয়। আমাদের এখানকার এক স্থানীয় শিল্পী বিমল পোদ্দারের থেকে এই কাজটা শিখি”, বলছিলেন প্রতাপবাবু। কথায় কথায় জানা গেল, ২০০৭ সাল নাগাদ কলেজে পড়াকালীন সময় থেকে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই শিল্পের। কিন্তু শিল্পের উপাদান হিসাবে বাঁশের মোথাকেই বেছে নেওয়া কেন?
আরও পড়ুন
ব্যঙ্গচিত্রের হাত ধরেই রাজনৈতিক বিনোদনের ফুল ফোটাচ্ছেন বাংলার ‘মালি’
প্রতাপবাবু জানালেন, “প্রথমে মাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম। কাঠেও করেছি। আমার গুরুদেব কাঠের কাজ করতেন। বড়ো কাঠ থেকে যে চোকলা উঠে আসত, সেগুলোকে বাড়িতে নিয়ে এসে তার ওপরে কাজ করতাম। কিন্তু সবসময় কাঠের গুঁড়ি পাওয়া মুশকিল। কাজেই বিকল্প মেটিরিয়ালের সন্ধান করছিলাম আমি। আমাদের গ্রামের বাড়ির আশেপাশে প্রচুর বাঁশঝাড় আছে। সহজলভ্য বলে বাঁশের মোথা দিয়েই কাজ শুরু করি। টুকটাক কাজ করতে করতে দেখলাম বেশ ভালো লাগছে। আনন্দ পাচ্ছি কাজটায়। শিল্পের জন্য তাই এটাকেই বেছে নিলাম।”
আরও পড়ুন
দিনবদলের স্বপ্ন দেওয়ালজুড়ে, তৌসিফ হকের ছবিতেই ভাষা পাচ্ছে বাম ইস্তেহার
শিল্পী জানালেন, আপাতত বাণিজ্যিকভাবে দেখছেন না বিষয়টিকে। এই মুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই কারুকাজগুলি বিক্রি করারও। কেবলমাত্র নির্মেদ ভালোবাসা থেকেই এই কাজ করে চলা। এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকটি এগজিবিশনে প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর এই শিল্পকর্ম। আরও দুটি প্রদর্শনীর কথা ঠিক হয়েছিল ২০২০ সালের শুরুতে। তবে লকডাউন আর মহামারীর কারণেই শেষ অবধি সম্ভব হয়ে ওঠেনি তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিল্পোৎসাহী দর্শকেরা আবার সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন এই অপার্থিব সৃষ্টিগুলি।
বাঁশের মোথা দিয়ে এই ধরণের কাজ ইতিপূর্বে বাংলায় প্রায় হয়নি বললেই চলে। কিন্তু বাঁশের মূল অংশ দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রচলন ছিল বাংলায়। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেসব। সেই আক্ষেপ ঝরে পড়ল প্রতাপবাবুর কথায়, “বাঁশ তো বটেই, বহু শিল্পই হারিয়ে যেতে বসেছে। যেমন, সরা শিল্প। আসলে শিল্পীদেরই কাজ এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা।”
আরও পড়ুন
মহাকর্ষ বল কাজে লাগিয়ে স্থাপত্য, পাথর ব্যালেন্সিং-এর নেশায় মজে মার্কিন শিল্পী
কিন্তু এত এত হস্তশিল্প হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী? সাধারণ মানুষের মধ্যেই কি ঘাটতি দেখা যাচ্ছে উৎসাহের? তাঁরা কি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন শিল্প থেকে? আশার কথাই শোনালেন শিল্পী, “আমার তেমনটা মনে হয় না। বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনীতে গিয়ে দেখেছি সেখানে ভিড় হয়। মানুষ কেনাকাটা করেন। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে অনেকেই এই ধরণের প্রদর্শনী দেখতে যান। সেই মানসিকতাটা হারায়নি এখনও। যাঁরা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন, শিল্পের প্রতি তাঁদের একটা দায়িত্ব রয়েছে। যদি একটি প্রদর্শনীশালা গড়ে ওঠে, তাহলে এই কাজগুলো নতুন প্রজন্ম দেখবে, শিখবে, প্রভাবিত হবে। একমাত্র সেভাবেই টিকিয়ে রাখা যায় একটা শিল্পকে।”
তবে শুধু শিল্পী বললে সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয় না তাঁর। অভিনব হস্তশিল্পের পাশাপাশি সমানভাবে তিনি উজ্জ্বল সাহিত্যের জগতেও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন প্রতাপবাবু। লেখালিখির হাত ধরা সেই কলেজ জীবন থেকেই। তখন অবশ্য ডায়েরিতেই বন্দি থাকত সেসব লেখারা। ২০১৪ সাল নাগাদ প্রথম কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা কবিতা। বর্তমানে ‘কবিতা আশ্রম’, ‘গোরাগাঙনি’, ‘ভাষাপথ’-সহ একাধিক পত্রিকাতে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাঁর কবিতা। ২০১৯ সালে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ডোয়া’।
পেশাগতভাবে শিক্ষক হলেও শিল্প-সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরে রূপকথার এক যাপনচিত্র তাঁর। আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? অকুণ্ঠভাবেই জানালেন, আপাতত বাঁশের মোথার এই অভিনব শিল্পক্ষেত্রে আরও গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করতে চান তিনি। “আরও বড়ো করে এই কাজ করার পরিকল্পনা আছে”, বলছিলেন প্রতাপবাবু। সুতরাং আগামীতে যে দর্শকদের জন্য নতুন চমক আসতে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor