নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। বাংলার সংস্কৃতির জগতে ঘটে গেল এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। নিজের লেখা গান আর গিটার হাতে এগিয়ে এলেন সুমন চট্টোপাধ্যায় নামের এক বিদেশ ফেরত ভদ্রলোক। তাঁর কথা, গান আর সুরের হাত ধরে নতুন রাস্তায় নামল বাঙালি। বাংলা গানে ঘুরে ফিরে আসতে লাগল আম জনতার কথা, প্রেম আর বিপ্লবের আগুন, রোম্যান্টিসিজম। যে সময় সুমনের আত্মপ্রকাশ, তার ঠিক এক বছর পরে আরও এক নতুন শিল্পীর মুখ দেখেছিল বাংলা। কোঁকড়ানো চুল, দাড়ি-গোঁফের ভিড়ে চকচকে দুটি চোখ নিয়ে তিনি শুনিয়েছিলেন ‘এই বেশ ভালো আছি’। তারপর কেটে গেছে বহু বছর। কলকাতা আরও নাগরিক হয়েছে। বহু পরিবর্তন দেখেছে, বিপ্লব দেখেছে। আর সেসবের সাক্ষী থেকেছে সেই একমুখ দাড়ির লোকটা। কলমটা তাঁর কাছে তরোয়ালের থেকে কম কিছু নয়; গিটারটা বিপ্লবে দীক্ষিত করার মন্ত্র জানে। উত্তর কলকাতার এক সাধারণ ছেলে নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘নচিকেতা’ হয়ে ওঠার যাত্রাটির পরতে পরতে যে জড়িয়ে আছে সেই বিপ্লবেরই সুর…
তাঁর ভক্তরা ভালোবেসে নাম দিয়েছেন ‘আগুনপাখি’। ফিনিক্স! নিভে যাওয়া ছাইয়ের ভেতর থেকে জন্ম তাঁর, নিজের আগুন দিয়ে চিনিয়ে দেওয়া সমাজের সব দিককে। নচিকেতার গান মানে জীবনের কথা, জীবনমুখী গানের এক সার্থক পুরুষ। চিলেকোঠার ভেজা দুপুরে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে চাওয়া ছেলেটার আশ্রয় হয়ে ওঠে গানগুলো। কখনও ‘নীলাঞ্জনা’র জন্য গাওয়া সাধারণ, ছাপোষা না-হওয়া এক প্রেমের গান, কখনও ‘বৃদ্ধাশ্রম’-এর চোখে জল এনে দেওয়া সুর। ‘তুমি আসবে বলে’-র ‘তুমি’টা ঠিক কে? বহুবার বহুজন এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আজও করছেন। তিনশোটিরও বেশি গান গাওয়া হয়ে গেছে তাঁর। তবে নচিকেতা রয়েছেন নচিকেতাতেই!
আর পাঁচটা বাঙালির জীবনের মুখের ভাষা উঠে আসে তাঁর কলমে। সেখানে যেমন থাকে গালাগালি, তেমনই থাকে প্রতিদিনের ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দ। এই সহজ কথার মাধ্যমে সমকালকে তুলে ধরা, নিজের কথা-দেখাকে তুলে ধরা— নচিকেতা সেই কাজটাই করে গেছেন। তার ভেতরেই পুরে দিয়েছেন বারুদ। ‘এই বেশ ভালো আছি’ থেকে যে পথটা চলা শুরু হয়েছিল, সেটাই জারি আছে আজও। নিজের কাছে যেটা ঠিক বলে মনে হয়, সেটাকেই সপাটে বলে দেওয়া। ‘আগুনপাখি’রা কোনদিনও কারোর পরোয়া করেছে কি?
গান শেখা কার কাছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে আসবে রেডিও’র কথা। আর সিস্টেম, যা প্রতিটা শব্দ জুগিয়েছে কলমে। আর নীলাঞ্জনা? বরাবরের মতো চুপ নচিকেতা। নীলাঞ্জনা যেন এক রহস্যময়ী; যার পরিচয় জানা যায় না। কিন্তু বাড়ির উল্টোদিকের জানলার ধারে হয়তো তাঁকেই দেখতে পাবেন আপনি। ঠিক যেমন দেখতে পাবেন নচিকেতাকে। খামখেয়ালি এক যুবক, একচোখ স্বপ্ন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন পথে। অজস্র আলো, হাততালি এড়িয়ে বেছে নিচ্ছেন চা-গুমটি। দেখছেন, ভাঙছেন; আবার গড়ছেন। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি বেরনোর পর স্থানীয় এক নেতা নচিকেতাকে নিয়ে গেলেন এক বৃদ্ধাশ্রমেরই উদ্বোধন করাতে! সব দেখে বেরিয়ে এলেন নচিকেতা। রাগে ফুঁসছেন তিনি। আপনি আসবেন না? নচিকেতার উত্তর, যেদিন এই বৃদ্ধাশ্রমে তালা মারা হবে, সেদিন আসব…
আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত প্রেমে মিশে গেল কলকাতাও, ঝড়ের বেগে ‘তোমাকে চাই’ লিখলেন কবীর সুমন
‘বিড়ি হল অভিমানী প্রেমিকার মতো। সবসময় চুমু খেতে হয়’— শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া এই লাইনটির সঙ্গে কি পরিচিত নচিকেতা? আজ বাংলার প্রতিটি কোণায় তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেকের কাছে তিনি কিংবদন্তি, কেউ কেউ খারাপও বলেন। কিন্তু নিজের আকর রয়ে গেছে একই। দামি সিগারেটের বদলে সেই ‘অভিমানী’ বিড়িই তাঁর নিত্যসঙ্গী। আগুন তো রাখতে হয়, তা না হলে ফিনিক্স জাগবে কী করে! সোশ্যাল মিডিয়ার ভিড়ও এড়িয়ে চলেন সযত্নে। গান, গিটার তো আছেই; নচিকেতার কলম বেছে নিয়েছে কবিতা, গল্পের ঠিকানাও।
পেছনে ফিরে তাকালে আজ কী মনে হয়? মায়ের ক্যানসার আক্রান্ত দিন, নিজের বেকার জীবন। টালমাটাল ভবিষ্যৎ। একটা গিটার, কলম, কিছু পাতা আর সুর— এই তো ছিল সম্বল। তা নিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে পড়া। আজ সুমন-অঞ্জনের সঙ্গেই উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। বাংলা গানের ধারা বদলে দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত, গরিব লড়াকু মানুষদের প্রতিবাদের ভাষা যুগিয়েছেন তিনি।। আসলে লড়াইটা নচিকেতার সহজাত। আজও করে যাচ্ছেন তাই। ছাই হচ্ছেন, আবার জেগে উঠছেন। তিনিই তো বলেছিলেন, “একদিন ঝড় থেমে যাবে/ পৃথিবী আবার শান্ত হবে”…
আরও পড়ুন
‘#ভাগ্যিসসুমনছিলেন’, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠছে কবীর সুমনের গান
Powered by Froala Editor