চারপাশের পৃথিবীটার অনেকরকমের ধ্বনি একসঙ্গে জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় পরমেলু। পরমেলু কত্থক নাচের বোলবাণীর একটি ধারা। যে সমস্ত ছন্দ ও তালাশ্রিত শব্দবন্ধ ঘিরে রচিত হয় নাচের ভঙ্গিমা, সে’সবই বোলবাণী। গণেশ বন্দনা, আমদ, থাট, নটবরী, পরমেলু, পরণ, ক্রমলয়, কবিতা, তোড়া ও টুকরা, সংগীত ও প্রাধান—এই নিয়ে তৈরি কত্থকের শরীর। এর মধ্যে, পরমেলু অংশে বাদ্যধ্বনির সঙ্গে জুড়ে থাকে নাচ। ধ্বনি এখানে নিছক শব্দ নয়, তা যেন প্রকৃতির জীবনভাণ্ডার ছেনে তুলে আনা অপার সব গল্পবীজ।
পরমেলুর শব্দগুচ্ছে বিচিত্র সব ধ্বনি ভারী অদ্ভুতভাবে মিলে-মিশে থাকে কত্থকি উচ্চারণের সঙ্গে। পরমেলুর পড়ন্ত্ অর্থাৎ আবৃত্তি-ও তার সেই নিহিত ভাবকে বহন করে। পরমেলুতে তবলা, মঞ্জীরা, পাখোয়াজ ইত্যাদি বাজনার বোল এবং এমন অনেক বহু প্রাচীন শব্দের কাজ থাকে, যার অর্থ অনেকদিনের অব্যবহারে হারিয়ে গেছে অথচ তাল, ছন্দের গুণই হয়তো শব্দগুলোকে হারাতে দেয়নি।
অনেক সময় ইচ্ছে মতো কিছু ধ্বনি বেছে নিয়ে তার উচ্চারণ নিয়েও খেলা করা যায় পরমেলুতে। আবার ধ্বনির প্রয়োগে ভাবের প্রকাশও পরমেলুর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যেমন, লখনৌ ঘরানার একটি পরমেলুর ক্ষেত্রে দেখা যায়- “ধেৎতাম ধেৎতাম ধাগে ধাগে থুন তাকা থো”-- বাণীর এই অংশে ধ, থ এই মহাপ্রাণ ধ্বনি ব্যবহৃত হয়েছে এবং “তাকিটে ধিকিটে তাকা থুন তাক”-- এই অংশের ধ্বনিগুলি অল্পপ্রাণ। বোঝা যায়, কঠিন ও কোমল দুটি ভাবেরই একত্র রসত্ব প্রাপ্তি ঘটাতে চাওয়া হয়েছে এখানে। কুকু শব্দে ধ্বনিত হয় পাখি, থারি, থুরাঙ্গা, ঝিঝিকিট, ছন ইত্যাদি শব্দ ও তার উচ্চারণের ফেরে কখনো শোনা যায় ঘুঙুর, কখনো ঝরনা বা পাতা ঝরার কথা। পরমেলুর আশ্চর্য জগতে এভাবেই জড়িয়ে থাকে প্রকৃতির শব্দেরা, ধ্বনিরা।
প্রসঙ্গত, পরমেলুর নাচের আঙ্গিকে কিন্তু সাধারণত শব্দগুলির অভিনয় থাকে না। বোলের এই বিচিত্র ধ্বনিগুলি আবৃত্তির গুণেই আগ্রহী দর্শকের মনে থুড়ি কানে তৈরি করে দিতে পারে শিল্পীর ইচ্ছেমতো নানা শব্দ। ঠিক যেমন, কেউ একটানা ঘুঙুরের ঝমঝম শুনলে তার মনে হবেই জলপ্রপাত ঝেঁপে নামছে তার আশেপাশে কোথাও। এও এক আশ্চর্য। চারপাশের শব্দগুলোকে ছুঁয়ে, ছেনে সার্থক শিল্প গড়ে নেওয়া কিন্তু একেবারে সহজ কথা নয়। বেমালুম ভুল বোঝাবুঝির এই বিচ্ছিরি সময়ে এইসমস্ত অনুসন্ধান আশার আলো নিয়ে আসে বৈকি।