হেমন্তের আমেজে কার্তিক এক পূজা মুখরিত মাস। অন্যদিকে অগ্রহায়ণ একান্তই নলেনগুড়ে ভেজা, শিশিরধৌত উৎসবের মাস। যে মাসের পয়লা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত শুধুই নবান্ন উৎসবের সমারোহ ও ব্যাপ্তি, গ্রামবাংলার মানুষের মুখে-মুখে যা হয়ে দাঁড়িয়েছে 'নবান উৎসব'। জানা যায়, মধ্যযুগের বাংলাতে কার্তিক ছিল বছরের শেষ মাস এবং অগ্রহায়ণ ছিল প্রথম মাস। মোঘল আমলে পয়লা অগ্রহায়ণের দিন আকবর বাঙালির খাজনা দেওয়ার দিন হিসাবে নির্দেশ জারি করেন। ইরানি জ্যোতিষবিদের মত নিয়ে টোডরমলকে তিনি নির্দেশ দেন এই সিদ্ধান্ত বাংলায় প্রচার করতে। তাই পয়লা অগ্রহায়ণ ছিল বাঙালির নববর্ষ।
সেই সময় কিছুকিছু বণিক পয়লা বৈশাখ হালখাতা করলে তাকে ব্যঙ্গ করা হতো 'লোভী বণিক' হিসাবে। অগ্রহায়ণ মাসের পয়লা নববর্ষ এবং খাজনা আদায়ের মূল কারণ ছিল বাঙালির ঘরে শস্যের প্রাচুর্য। এই সময় মড়াই ও গোলাগুলো শস্যে ভরে থাকত। ধনী দরিদ্র সক্কলেই ধান ওঠাকে কেন্দ্র করে মেতে উঠত নবান্নের মূল সুরে। বিদেশে কর্মরত বণিকদল দেশে ফিরত নবান্ন উপলক্ষে। মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে ফিরতো নবান্নের স্বাদগ্রহণ করার জন্য। এই প্রসঙ্গে রাঢ়দেশীয় বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস লিখেছিলেন – ‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/বৃন্দাবন বন ভেল।।’ কখনওবা কবি লোচন দাস লিখেছিলেন – ‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।/সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে॥/পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।/সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে।’। কিংবা কবি নজরুল ইসলামের কবিতাতেও ভেসে ওঠে –‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া/সেই নাচনে উঠল মেতে।/টইটুম্বুর ঝিলের জলে/ ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে/চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে/ সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’ কবি নজরুল হেমন্তের প্রবাহিত ধারাতে অবগাহন করে লেখেন – ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণীর সওগাত।/ নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাৎ।/ গিন্নি পাগল চালের ফিরনি/তশতরী ভরে নবীনা গিন্নী/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীদের খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি বাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেস্মাত।’ এখানেও আমরা হেমন্তের নতুন ধানের উৎসবে গৃহস্থের বাড়িতে উৎসবের চিত্রটি খুঁজে পাই।
নবান্নের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের যেতে হবে প্রাচীন বাংলায়। যেখানে আদি অস্ট্রেলীয় বাঙালিরা নতুন ধান গুঁড়ো করে উৎসব করত জাঁকজমকভাবে। এখানের ধানই হল মূল শস্য এবং ধানকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের ধারা বয়ে চলে, তাই ধানকে কেন্দ্র করে নবান্ন উৎসব বঙ্গে বিশাল সমারোহে পালিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। নবান্ন মূলত গোটা অঘ্রাণ মাস জুড়েই পালিত হলেও এর প্রাথমিক সূত্রপাত হয় কার্তিক সংক্রান্তির দিন ভোরে। এই সংক্রান্তি তিথিতে গৃহস্থের বাড়ির একজনকে স্নান করে শুদ্ধবস্ত্রে যেতে হয় জমিতে। সেই জমিতে, যেখানে নবান্নের জন্য ধান লাগানো হয়। তারপর দূর্বাঘাস, গঙ্গাজল, মণ্ডা বা সন্দেশ দিয়ে আড়াই গাছি ধানকে কেটে বাড়ি নিয়ে আসা হয়, তারপর সেই ধানের পূজা বা মুঠপূজা দিয়েই শুরু হয় নবান্নের আসল আরাধনা। পরে চাষিরা সেই ধান মাঠ থেকে কেটে নিয়ে ঝাড়াই করলে, গ্রামে গ্রামে এখনও নবান্নের জন্য বেছে নেওয়া ধানকে বাড়ির পুরুষরা শুদ্ধ বস্ত্রে সংগ্রহ করা হয়। বাড়ি মহিলারা স্নান করে ভোরে উঠে নবান্নের ধানকে সিদ্ধ করে উঠোনে বা ছাদে শুকোতে দেয়। ধান শুকিয়ে গেলে সঠিক তিথি দেখে সেই ধানকে ভাঙিয়ে আনা হয় ধানকল থেকে, যা আগে ঢেঁকিতে ভাঙা হত, তাই আগেকার দিনে সারা কার্তিক মাস জুড়ে ঢেঁকি সারানো হত। ধানকল থেকে ভাঙিয়ে আনা নবান্নের চালকে নবান্নের আগের দিন বিকালে বা সন্ধ্যাতে হামালদিস্তাতে গুঁড়ো গুঁড়ো করা হয় শুদ্ধ কাপড় পরে।
মূলত লঘু ধান বা গোবিন্দভোগ চাল দিয়েই নবান্ন হয় রাঢ়দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে। সেই ধান দিয়েই নবান্নের জন্য সিন্নি তৈরি হয়, তাতে চালগুঁড়োর সাথে মেশানো হয় বিভিন্ন ফলের কুচি, ক্ষীর, দুধ, সন্দেশ, আদা কুচি, আখের টুকরো, মুলো কুচি প্রভৃতি। নবান্নের দুদিন আগে থেকেই সবজি ও ফলের বাজার করা শুরু হয়ে যায়। অঘ্রাণ মাসের বিভিন্ন শুভদিনগুলিতে নবান্নের দিন স্থির হওয়ায় বাজার আগুন থাকে, তাই আগাম বাজার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে খুবই লাভজনক হয়। তবে নবান্নের আগের দিন সকালে মুদিখানা বাজার করে বেশিরভাগ মানুষ কারণ বিকাল থেকে বিভিন্ন সবজি ও মাছের পদগুলিকে আগে থেকে তেলে কষে রাখা হয়, এছাড়াও বিভিন্ন সেদিন গ্রামের সব পুকুরেই মাছ ধরে। যাদের পুকুর আছে, তারা নিজেদের পুকুরে জেলে নামিয়ে মাছ ধরে, যাদের পুকুর নেই তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে বা কিনে আনে। পুকুরের অতিরিক্ত মাছ পড়শিকে দিয়ে দেয় মানুষ নবান্নের জন্য। কিংবা বহুকাল আগে থেকে সংরক্ষিত কুমড়ো ও জমির বেগুন, মূলো বা পালংশাক জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে ভাগ করে নেয়।
অবশেষে নবান্নের ভোর থেকেই শুরু হয় হয়ে গ্রামের মধ্যে সাজো সাজো রব। সেদিন ভোরে ৩টে নাগাদ পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভোরাই গান 'রাই জাগো রাই' শোনা যায়। বাড়ির মহিলারা ভোর থাকতেই উঠে বাড়িতে ঝাড়পোছ, মারুলি সেরে লেগে পড়ে রান্নায়। কোথাও চোদ্দ রকম ভাজার পদ রান্না হয়, কোথাও বা একুশ পদ, সঙ্গে মাছের তিন রকম পদ(ভাজা, ঝোল, টক), নিরামিষ টক, ডাল, মালপোয়া, বেগুনি ইত্যাদি তো হবেই! শেষে পায়েস রান্না হয়। সকাল হতেই কলাবাগানে গিয়ে কলাপাতা কেটে নিয়ে আসার ধুম পড়ে যায় ছোট-বড়দের। তারপর একে একে সক্কলে চা খেয়েই স্নানপর্বটা সেরে নেয়, কারণ নবান্নের জন্য গ্রামের মূল মন্দিরগুলোতে নবান্নকে উৎসর্গ করে পূজা হয়। বিশেষত গ্রাম্যদেবীর পূজা, কোথাও বা অন্নপূর্ণা পূজাও। একবারে শেষে বাড়ির তুলসী মন্দিরে বাড়ির যজমানি পুরোহিতকে দিয়ে হরির নবান্ন পূজা এবং সমস্ত পূজার প্রসাদ একত্রিতভাবে চালগুঁড়ো সিন্নির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বাড়ির সক্কলকে দেওয়া হয়।
প্রথমে নবান্নের ভোগ দেওয়া হয় বাড়ির বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে মাঝউঠোনে, তারপর শিশুকিশোরদের। স্নানের পর তারা নতুন জামা পরে মাটিতে আসন পেতে বসে, কলাপাতার উপর নবান্ন খাবে বলে। ছোটোদের সারা হলে বড়োরা বসে। নবান্নের চালগুঁড়ো খাওয়া হলে নিয়ম মিলিয়ে দুপুরের খাওয়ার খেয়ে হয়, কারণ বারবেলা পড়ে গেলে আর খাওয়ার নিয়ম থাকে না। তাই খাওয়ার সময়টা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এভাবে দুপুর পার হয়ে রাত আসে কিন্তু বাড়িতে আর রান্না চাপে না, কারণ নবান্নের দিনে নতুন করে আর উনুন জ্বালাবার বিধি নেই।
নবান্নের পর দিনকে বলে পান্ত(বাসি) বা বাস নবান্ন। সেদিন নবান্নের দিনে তৈরি সমস্ত পদগুলির বাসি খাওয়ার নিয়ম। অনেক জায়গায় অবশ্য এই বাসি পদের সাথে যুক্ত হয় খাসির মাংস। সেদিনও উনুন ধরানো হয় না বাড়িতে। পান্ত নবান্নের দিন কার্তিক পূজার দিন হিসাবেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কার্তিক লৌকিক দেবতা তথা প্রজননের দেবতা তাই নবান্ন উপলক্ষে তার পূজা হওয়াটা রাঢ়বঙ্গের সংস্কৃতির একটি অঙ্গ বলা যায়। পরিশেষে বলি, নবান্ন উৎসব আজও এই বঙ্গে টিকে আছে সংখ্যাতীত গ্রামে, যার খবর শহরবাসী মানুষদের কাছে ভিনদেশি উৎসবের মতো।