সাত মাস আগে, গতবছর নভেম্বর মাসে প্রয়াত হলেন নবনীতা দেবসেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিদগ্ধ লেখিকা, চিন্তাজীবী, ভালোবাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ‘নবনীতাদি’ হয়েই তিনি সকলের প্রাণের কাছে হাতছানি দিয়ে গিয়েছেন। তুলনামূলক সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞান, নিরন্তর ভাষাচর্চার সুবাদে তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি নতুন করে রামায়ণ লিখে যাওয়া বাংলা তথা ভারতের বেশ কিছু সাহসিনীদের কথা।
দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘গল্পসমগ্র’-এর ‘ভণিতা অংশ’-এ তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বীর্য বাহুবল সর্বস্ব পুরুষ মানুষের যুদ্ধকাব্যের জগতে নারীর ঠাঁই বড় করুণ’। একথা শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও, তা নিখাদ সত্য। মহাকাব্যের যে বীরত্ব, পরাক্রম, বাহুবল-মনোবলের দেখনদারি তার সাথে সনাতন ধারণায় নারীর স্থান নেই। বীরত্ব আর পৌরুষ হয়তো নিকটস্থানীয় শব্দ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে চন্দ্রাবতী নাম্নী এক নারীই প্রথম নতুন করে রামায়ণ লেখার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। সেই রামায়ণে মূল ভাব অক্ষুণ্ন থাকলেও, তা ছিল নারীর দৃষ্টিকোণে লেখা। মধ্যযুগের বাংলার একমাত্র মহিলা লোক-কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণের থেকেও তাঁর ব্যক্তিজীবন এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে, ময়মনসিংহ গীতিকায় নয়ানচাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী পালা’ পড়লেই তা বোঝা যাবে। চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণে মাত্র তিনটি খণ্ড রয়েছে – ১ম পরিচ্ছেদে রাবণরাজার বীরত্ব-বিজয় মহিমা, লঙ্কার বৈভব বর্ণনা, ২য় পরিচ্ছেদে সীতার বারমাসী, তার জীবনের সুখ-দুঃখের কথা আর শেষ পরিচ্ছেদে সীতার বনবাস, সন্তান প্রসব এবং অবশেষে অগ্নিপরীক্ষায় অপমানিতা সীতার পাতালে প্রবেশ।
বলা বাহুল্য, এই রামায়ণ মূল বাল্মীকি-রামায়ণের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। রামকে এখানে ‘পাষাণহৃদয়’, ‘পাপিষ্ঠ’ বলা হয়েছে, এমনকি রামকে বিকৃতমস্তিষ্ক, সন্দেহপরায়ণ, দুর্বল স্বামী হিসেবেই দেখিয়েছেন চন্দ্রাবতী। মূল রামায়ণের বালকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড সনাতন মহলে বেশি অবহেলিত অথচ চন্দ্রাবতী (এবং পরে দেখা যাবে অন্যান্য নারীরাও) এই দুটি কাণ্ডের সীতার চরিত্রকে মুখ্য করে তাঁর দুঃখ-যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে নতুনভাবে লেখেন রামায়ণ। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের ব্রাহ্মণকন্যা চন্দ্রাবতীর রামায়ণ লেখা হয়েছিল ষোড়শ শতকে আর ঐ একইসময় তেলেগু ভাষায় অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরের কাছের গ্রাম গোপভরমে বসে ধ্রুপদী রামায়ণ লিখেছেন মল্লা, আরেক সাহসিনী। মল্লা জাতিতে শূদ্র হয়েও ধ্রুপদী রামায়ণ লিখেছেন আর তাই রাজসভায় তাঁর রামায়ণ পাঠ করতে দেননি ব্রাহ্মণ সভাকবিরা। আর অন্যদিকে চন্দ্রাবতীর রামায়ণও সারস্বত-সমাজে খ্যাতি পায়নি। মল্লা’র রামায়ণ পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকার করে লেখা হলেও তাঁর প্রতিবাদ ছিল আসলে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। আবার আরেক তেলেগুভাষী মহিলা রঙ্গনায়কাম্মা লিখেছিলেন আরেক রামায়ণ ‘রামায়ণম্ বিষবৃক্ষম্’। এই রচনা ছিল সম্পূর্ণই মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা, এমনটাই জানিয়েছেন নবনীতা দেবসেন তাঁর গবেষণা-প্রবন্ধে।
আরও পড়ুন
ভিল আদিবাসীদের নিজস্ব এই মহাভারত, ‘ইকো দানব’-কে হত্যাই যেখানে কৃষ্ণের অন্তিম সাফল্য
আশ্চর্যের কথা, পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে আক্রমণ করায় সামাজিকভাবে একঘরে হতে হয়েছিল রঙ্গনায়কাম্মাকে। আসলে দেখা যাবে, পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদ রামকে কেন্দ্র করে যে মিথ্ গড়ে তুলেছে তাতে সীতা অবহেলিত আর এই মিথকেই ভেঙে ফেলে এই নারীদের রামায়ণে সীতা এসেছেন কাহিনি-কেন্দ্রে। যদিও সীতা তাঁদের লেখায় কোনো নারীবাদী বিপ্লবী নন, বরং তিনি নির্যাতিতা, পীড়িতা, এক দুঃখিনী স্ত্রী। সমস্ত ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে গিয়ে এই নারীদের রামায়ণে স্থান পায় না যুদ্ধের আড়ম্বর, রামের বীরত্ব কিংবা লঙ্কাপতি রাবণের বৈভব বরং আরো বেশি ফুটে ওঠে সীতার বিবাহ, সন্তান প্রসব এবং তাঁর পরিত্যক্ত হওয়ার কথা। অগ্নিপরীক্ষা ও সীতা বর্জন এই দুটি ঘটনা নারীর লেখা রামায়ণে রামের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছে।
আরও পড়ুন
নিতান্ত ছেলেবেলাতেই শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের রামায়ণ-চর্চা
এছাড়াও তেলেগু, মারাঠি আর মৈথিলী ভাষায় গ্রামের মেয়েদের সীতাকে নিয়ে মুখে মুখে রচনা করা রামায়ণ গানগুলিও তাঁর নজরে পড়েছে, সে নিয়ে তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষাও করেছেন। এইসব মেঠো গান-পাঁচালিতে সীতার জীবনযন্ত্রণার সঙ্গে মিশে যায় গ্রাম্য মেয়েদের সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা। মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিক কষ্ট, অধিকারহীনতার বেদনাই এই গানগুলির মধ্যে দিয়ে সীতার মিথ্কে নারীজীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। নারীর কোনো স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় নেই, স্বামীর পরিচয়েই তার পরিচিতি। শ্বশুরবাড়িতে সীতার হেনস্থা আর নির্যাতনের কথা পাওয়া যায় মৈথিলী মেয়েদের গানে। এইসমস্ত পল্লীগীতিগুলি সীতার জীবনের নানা পর্যায় যেমন সীতার বাল্যকাল, তাঁর বিবাহ, স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি আগমণ, গর্ভসঞ্চার, সন্তান প্রসব ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেই গাওয়া হয় বলেই জানিয়েছেন নবনীতা।
যাইহোক, এ-প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বললে অত্যুক্তি হবে না বোধ করি। একেবারে বিংশ শতাব্দীতে এসে নবনীতা নিজেই রামায়ণ কাহিনির নবনির্মাণ ঘটান তাঁর ‘সীতা থেকে শুরু’ বইতে। সেখানে ‘অমরত্বের ফাঁদে’ গল্পে সীতা-সরমা-ত্রিজটার পারস্পরিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে উঠে আসে রামের কাছে সীতা আসলে ভোগ্যপণ্য। ‘সীতার পাতাল প্রবেশ’ গল্পে সীতা প্রতিবাদিনী, রামের শত অনুরোধেও তিনি তাঁর তঞ্চক, অবিবেচক স্বামীর কাছে ফিরে যাননি, ধিক্কার দিয়েছেন রামকে। যদিও শুধুই রামায়ণ কাহিনির মধ্যেই আটকে থাকেনি নবনীতার এই লেখাগুলি।
আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য মহাভারত হোক বা কমিকস – কলকাতায় পুরনো বইয়ের ‘দেবদূত’ এই দীপঙ্করবাবুরাই
আর সবশেষে বাংলার আরেক বিদূষী লিখলেন নতুন যুগের রামায়ণ, কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘সীতায়ন’ উপন্যাস বাল্মীকির মহাকব্যের একটি ‘অল্টারনেট স্টাডি’। সীতার চোখ দিয়ে দেখলে ঠিক কেমন চেহারা হত রামায়ণের? লঙ্কায় বন্দী থাকাকালে সীতা সামনে অপেক্ষার দীর্ঘ সমুদ্র তরঙ্গায়িত ছিল কিন্তু মুক্তি পেয়েও যেদিন তাঁকে বিনা অপরাধে ফের পাঠানো হল নির্বাসনে সেদিন নারীর সম্মানের ঊর্ধ্বে স্থান পেয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতা। আর সেই রাষ্ট্রও সীতার আপন নয়, স্বামীও নয়, পুত্রেরাও নয়। আধুনিক সমাজ যখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত ভাবিত, এত সরব – সেখানে দাঁড়িয়ে এই সাহসিনীরা তাঁদের লেখার মধ্য দিয়ে প্রশ্ন করেছেন মহাকাব্যে নিহিত পুরুষ-প্রাধান্যকে, প্রশ্ন করেছেন সমাজে প্রচলিত পুরাণকাহিনির পুরুষতান্ত্রিক মিথগুলিকেও।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
এই গুহাগুলির সামনেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন মহাভারতের ভীম