"তুমি সুস্থ হবে।
আমি দিয়ে দেব আমার কোজাগরীর চাঁদ
সাদা দেওয়ালের মময়ূরকণ্ঠী আলো,
দিয়ে দেবো বিগত বছরের মরা পখির মমতা
আর আগামী বছরের কলাগাছটির স্বপ্ন...."
[আরোগ্য; নবনীতা দেব সেন]
ভালো-বাসার বারান্দা খালি করে চলে গিয়েছেন নবনীতা। দুবছর আগের নভেম্বর মাস। শহরের উঠোন জুড়ে ভরপুর হেমন্ত। দেখতে দেখতে বারোমাস কেটেছে। পৃথিবী এখন একটা গভীরতর অসুখের সামনে। নবনীতা থাকলে হয়তো এতদিনে বুনে ফেলতেন আরোকটি আরোগ্যময় আখর। নতুন করে বলতেন হয়তো - "বিশল্যকরণী নেই; ধমনীতে রক্ত আছে, দেব...।" মানুষ এবার শুধু তার শুদ্ধ চোখদুটো মেলুক।
কবিতা লেখা ছাড়া নাকি গত্যন্তর ছিল না তাঁর। বাবা-মা দায়িত্ব নিয়ে হাতে-খড়ি দিয়েছিলেন কবিতায়। নরেন দেব শিখিয়েছিলেন পদ্য রচনা৷ উত্তম মিল, অধম মিল থেকে পয়ার ত্রিপদী, মন্দাক্রান্তায় গড়িয়ে ছিল সেসব কবিতার ক্লাস। আর রাধারানি দেবী তো একাই দুজন কবি। অপরাজিতা ছদ্মনামেও চলত তাঁর লেখালিখি। তিনি শিখিয়েছিলেন, সনেট। শিখিয়েছিলেন, চতুর্দশ মাত্রার চতুর্দশ পংক্তির অন্ত্যমিল। তাছাড়া ছিলেন শিক্ষক বুদ্ধদেব বসু, সামনেই কবিতা ভবন [আজ অবশ্য শুধু কাঠামোটাই।]। সুধীন্দ্রনাথ, অরুণ সরকার, নরেশ গুহ- এতজনের সান্নিধ্যই নাকি বাধ্য করেছিল নবনীতাকে কবি হতে। তবে বাবা-মা কবি হওয়ায় সমস্যাতেও ভুগেছিলেন খুব। ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের 'অগ্রগামী' ক্লাবে কবিতা প্রতিযোগিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নদী'র ভাবের সঙ্গে নিজের ভাব জড়িয়ে, আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'ঝরনা' কবিতার ছন্দে তার মিল ঘটিয়ে লিখেছিলেন তাঁর নিজের 'নদী' কবিতাটি। পুরস্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু শুনতে হয়েছিল, 'কীরে, কবিতাটা বাবা লিখে দেননি তো?'... কখনো আবার শুনেছিলেন, কবিতার ছন্দটি নাকি একদম তাঁর মায়ের লেখার অনুকরণ। লজ্জিত হয়েছেন ঠিকই। তবু কবিতার সঙ্গে আজীবনের বন্ধুতা তাঁর৷ নিঃসঙ্গতা, ব্যাধির যন্ত্রণা - সমস্তকিছুকে উড়িয়ে দিতে পারেন। শুধু আজীবনের প্রার্থনা ছিল, মৃত্যুর মুহূর্তেও কবিতা যেন তাঁকে ত্যাগ না করে। কবিতাই তাঁর সঞ্জীবনী সুধা। এই কারণেই হয়তো মৃত্যুকালীন আবহে অমন আঙুল তুলে বলতে পেরেছিলেন, "কামেন ফাইট..."।
কীভাবে কবিতা বসতি নিয়েছিল নবনীতার মনে? নবনীতা নিজেই বলেছেন, তাঁর কোনো বাঁধা কাব্যাদর্শ নেই। কবি, সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা ঠিকই, তবু কবিতা তাঁর জানা-অজানায় মিশিয়ে চেতনার অঙ্গ হয়েছিল আপনা থেকেই। ছোটোবেলায় ঘরে টাঙানো দুটি জিনিসের ওপর বারবার চোখ চলে যেত তাঁর। এক, ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি। সেখানে শীর্ণকায় যিশুর রক্তাক্ত হাতপা বারবার তাঁকে আচ্ছন্ন করত। আর দুই, ছবিটির ঠিক নিচেই টাঙানো একটি ক্যালেন্ডার, আর তার কয়েকটি অক্ষর। যেমন - ফাতেহা-দোয়াজ-দাহাম, 'ইদল ফিতর', 'ইদুজ্জোহা'। এইসব শব্দের অর্থ শৈশবে জানা ছিল না নবনীতার। কিন্তু শব্দের ভিতরে থেকে এক অদ্ভুত ধ্বনিমাধুর্য তাঁর কানকে আচ্ছন্ন করত। এইসব অচেনা শব্দে চড়ে গভীর রাতে নবনীতা দূর পাল্লার ট্রেনে অচিনপুরে পাড়ি জমাতেন। কখনো-বা চাঁদের বুড়ির চরকা-কাটার শব্দ তিনি শুনতে পেতেন এইসব শব্দের মধ্যে। পরে আবিষ্কার করেছিলেন, অর্থ জানা ছিল না বলেই, তারা এমন অলৌকিক অনুভূতি এনে দিত। অর্থের বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে শুধুমাত্র ধ্বনিই যে এমন কেরামতি দেখাতে পারে, ছোটোবেলাতে অজান্তেই সেই ম্যাজিকের ফাঁদে পড়েছিলেন তিনি। বুঝেছিলেন, কীভাবে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায়।
তবে ভীষণভাবে মনে হয়, নবনীতার স্বভাবের কথা। যা তাঁকে কবিতার ওপর অমন অধিকার ফলাতে দিয়েছে। নিজেই স্বীকার করেছিলেন, স্বভাবে তিনি খানিক বুনো। খাস কলকাতার মেয়ে হলেও, সজীব বুনো স্বভাবটি তাঁর আদ্যিকালের। তাই ঘাস দেখলেই খালি পায়ে নেমে পড়তে চাইতেন৷ জল দেখলেই ভাবতেন, যদি ঝুপুস করে একবার ডুব দেওয়া যেত৷ গাছ চড়তেও কোনো বেগ পেতে হত না৷ লোকের কথায় খেজুর গাছে উঠে খেজুর পেড়ে, নামার সময় হাতপা কাটাকুটি করে বীরদর্পে বাড়ি ফিরতেন। অধ্যাপনার সময়েও পেয়ারা গাছে উঠে ছাত্রীদের পেয়ারা পেড়ে খাইয়েছিলেন। গাছকে ভালোবাসলে নাকি তাতে চড়ার জন্যে খুব কসরত করতে হয় না। ছোটোবেলা থেকেই গাছের সঙ্গে নবনীতার সখ্য। কলকাতা শহর থেকে তখনো গাছেরা সদলবলে বিদায় নেয়নি। বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছ। বৃষ্টির দিনে তার শিকড়ের ফাঁকে ফাঁকে জল জমে পুকুর হয়ে থাকত। তা দেখে দেখে কবিতার অনুভূতিতেই মগ্ন হয়ে উঠতেন।
তাঁর কবিতায় যন্ত্রণাও যেন ইতিবাচকতায় ভরপুর হয়ে উঠত৷ ঠিক তাঁর জীবনের মতন। নবনীতা বলেছিলেন, তাঁর দু-চোখ নাকি দুরকম। একচোখ কেবল কাঁদে৷ হোহো হাসি, অট্টহাসির মধ্যেও কাঁদে৷ আরেক চোখে শুধুই হাসি। একেকসময় একেক চোখকে কাজে লাগিয়ে লেখালিখি করতেন নবনীতা। যদিও আমার গভীর বিশ্বাস কোনোভাবে ওই হাসির চোখটাকে জিতিয়ে দিতেন তিনি। মনে মনে পক্ষপাত থাকত তাঁর। নইলে, জীবনীশক্তির যে তীব্রতা তাঁর লেখায় মেলে, সে কাজ এত সহজ নয়। দ্বন্দ্ব, একাকিত্ব - তার ভিতরে কোথাও নেতি নেই। থাকলেও রয়ে গিয়েছে উত্তরণের বিপুল চেষ্টা। উত্তরণই তাঁর জীবনের সাধনা, প্রার্থনা...
আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের পরেও, জন্মদিনের লেখায় অমর্ত্যকে নবনীতা বলছেন - 'Treat this article as flowers...'
"সোনার হরিণ সোনার হরিণ
হীরের চোখ।
ঝরাক বৃষ্টি সোনালি ধানের
ফসল হোক..."।
কবিতাকে সেই প্রার্থনা থেকে বঞ্চিত করেননি কখনো। আমাদের মারী-আক্রান্ত পৃথিবীর কাছে সে কবিতা বাস্তবিকই পরিত্রাণ হয়ে উঠতে পারে।
তথ্য ঋণঃ 'নটী নবনীতা '- নবনীতা দেবসেন
আরও পড়ুন
যুগে-যুগে রামায়ণ লিখেছেন যে সাহসিনীরা, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবনীতা
Powered by Froala Editor