'মোহনবাগানি' নবনীতার ফুটবলে-প্রেমেও জড়িয়ে ছিল পিতৃতন্ত্রের দেওয়াল-ভাঙার মধুর স্বপ্ন

...মিঠু।
হে মা চন্ডী কতা রাখো
মোহনবাগান হারিও নাকো।
কুটু।
হে মা কালি শুইন্যা যাও
ইস্টব্যাঙ্গল জিতাইয়া দাও।
মিঠু।
ইস্টবেঙ্গল হেরে যাক
খ্যাকশিয়ালের মাথা খাক।
কুটু।
মোহনবাগান হারুক গিয়া
পূজা দিমু জোড়াপাঁঠা দিয়া!...


ছড়াটা পড়তে পড়তে, চায়ের আড্ডায়, ট্রেনে বাসে ট্রামে গলাফাটানো তর্ক-চিৎকার এমনকি পারস্পরিক হুমকিগুলো কানে ভাসবেই। ঘটি বাঙালের লড়াই-এর সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। চিংড়ি বনাম ইলিশ। স্টেডিয়ামের সেই সুপ্রাচীন ট্রাডিশন এখনও ধরে রেখেছে বাঙালি। তবে এমন মজার ছড়া বেরিয়েছে যাঁর কলম থেকে, সেই মানুষটাই তো আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন গত পরশু। খালি করে দিয়ে গেলেন 'ভালোবাসার বারান্দা'।

নবনীতা দেবসেন বেড়ে উঠেছিলেন ঠনঠনিয়া কালীতলা; 'ঘটিপাড়ায়'। সুতরাং তিনি যে আজন্ম মোহনবাগান-সমর্থক হবেন বলা বাহুল্য। শেষজীবন দক্ষিণ কলকাতার  'বাঙাল-মহলে' কাটালেও মোহনবাগান অন্ত প্রাণ রয়ে গিয়েছিলেন নবনীতা। তবে তাঁর লেখায় ইস্ট-মোহন সংক্রান্ত জাতবিদ্বেষ একেবারেই ছিল না, ছিল খাঁটি  রেষারেষির মজা।

আরও পড়ুন
যুগে-যুগে রামায়ণ লিখেছেন যে সাহসিনীরা, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবনীতা

যেমন একজায়গায় লিখছেন, "’ইলিশমাছ-চিংড়িমাছের লড়াইটায় অবশ্য আমার একটা সমস্যা ছিল। এখনো আছে। আমার চিংড়ি মাছে প্রবল আ্যলার্জি। আর ইলিশটাও দারুণ প্রিয় (আ্যলার্জিও নেই)। তবু যেদিন মোহনবাগান হারবে, সেদিন ইলিশ কেনার প্রশ্নই ওঠে না, দশটাকা কিলোতে বিকোলেও না। ঘটির গরব আছে না? মোহনবাগান হেরেছে তবু হাঁড়ি চড়েছে এই না কত!’

অবশ্য তাঁর এই মোহনবাগানপ্রীতির জন্য দায়ী দাদা অশোককুমার ঘোষ। ময়দানের তাঁবুতে অশোক ঘোষের নামটা চেনা। তাঁর কাছেই ১৯১১ সালের আইএফএ শিল্ড জয়ের গপ্প শুনেছিলেন তিনি। খালি পায়ে বুটপরা গোরাদের হারানোর সেই ইতিহাস আজও বাঙালির কাছে মিথ। যখন AIFF মোহনবাগানকে জাতীয় ক্লাব হিসেবে সম্মাননা দিয়েছিল, গর্বে ফেটে পড়েছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
বিচ্ছেদের পরেও, জন্মদিনের লেখায় অমর্ত্যকে নবনীতা বলছেন - 'Treat this article as flowers...'

তবে ফুটবল মাঠে একদিনের জন্যেও যাননি নবনীতা। ছোটবেলায় পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছেন চুটিয়ে। তাঁর ছোট্ট দুটো বাক্যেই কিন্ত ফুটে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার করুণ ছবি। ‘আমাদের সময় মেয়েরা ফুটবল মাঠে যেত না, ক্রিকেটের মাঠে যেত উল বুনতে। নব্বই মিনিটে উল বোনার সুবিধে নেই।’ একঝলকেই ভেসে ওঠে জাফর পানাহি পরিচালিত 'অফসাইড' ছবিটির দৃশ্য। যেখানে একটি মেয়ে, ছেলে সেজেই লুকিয়ে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ঢুকছে। গত দশকের গোড়ার দিকে নবনীতা দেবসেন শুরু করেছিলেন 'সইমেলা'। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় মেয়েদের অস্তিত্ব তুলে ধরার জন্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পায়ের নীচে দীর্ঘশ্বাস ফেলা নারীদের কথা ভাগ করে নেওয়ার মঞ্চই ছিল 'সই'। জীবদ্দশায় হয়তো দেখতে চেয়েছিলেন 'উল বোনা' ছেড়ে মেয়েরাও লাথি মারছে ফুটবলে। হয়তো তাঁর কানে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা ফুটবলারদের লড়াইয়ের গল্প।

আজীবন লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো নবনীতা হয়তো ফুটবল মাঠে, দর্শকের ভূমিকায় একদিন  হাততালি দিতে চেয়েছিলেন।

সে স্বপ্ন আর সত্যি হল কই?

ঋণ : প্রিয় মোহনবাগান ও আমরা - নবনীতা দেবসেন, ইস্ট মোহন ছড়া - নবনীতা দেবসেন

Powered by Froala Editor