উপনিষদ থেকে রামায়ণ, মহাভারত – ছট পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে নানা কাহিনি

প্রথম মনু স্বয়ম্ভূর পুত্র রাজা প্রিয়ব্রত। প্রথম যুগের মানুষদের নিয়ে দিব্যি রাজত্ব চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু একদিন তাঁর চিন্তা শুরু হয়, বয়স বেড়ে যাচ্ছে অথচ তাঁর কোনো উত্তরসূরির জন্ম হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঋষি কাশ্যপের পরামর্শ শুনে সূর্যের আরাধনা শুরু করলেন রাজা। বিরাট এক যজ্ঞের আয়োজনও হল। যজ্ঞ শেষ হতে না হতেই সন্তানলাভের লক্ষণ ফুটে ওঠে রানি মালিনীর শরীরে। সময় যায়। সন্তান ভূমিষ্ঠও হয়। কিন্তু দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত মৃত সন্তান প্রসব করেছেন রানি মালিনী। অবশেষে সূর্যের ছোট বোন দেবী কাত্যায়নীর আশীর্বাদে প্রাণ ফিরে পায় শিশু সন্তান। ছট পূজাকে ঘিরে সবচেয়ে প্রাচীন কিংবদন্তি সম্ভবত এটিই। উপনিষদের কাহিনিতে রাজা প্রিয়ব্রতর সন্তানলাভের এই গল্প জানা যায়। তবে বর্তমানে নেপালের মধেশ অঞ্চলের বাইরে আর এই কাহিনি শোনা যায় না। বরং ছট পুজোর (Chhath Puja) সঙ্গে মহাভারতের কর্ণের কাহিনি শুনতেই অভ্যস্থ আমরা।

কারণটা অবশ্য সহজেই বোঝা যায়। বর্তমানে ছট পুজোর যে প্রসার, তার সঙ্গে উত্তর বিহারের সম্পর্কই জড়িয়ে। আর মহাভারতের ভৌগলিক বর্ণনা অনুযায়ী এখানেই ছিল অঙ্গরাজ্য। অঙ্গরাজ্যের রাজা কর্ণ। তিনি আবার সূর্যপুত্রও। অস্ত্রশিক্ষার সময় থেকে কর্ণের নিয়মিত সূর্য আরাধনার কথাও উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে। অবশ্য কার্তিক মাসের শুক্ল ষষ্ঠী তিথিতে কর্ণের বিশেষ পূজার আয়োজনের উল্লেখ মূল মহাভারতে নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে লোকমুখে যে এই কাহিনি বিস্তার লাভ করেছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রচলিত নানা আচারের সঙ্গেই মহাকাব্যের কাহিনিকে জুড়ে নেওয়া হয়েছে নানা সময়ে।

তবে বিহারের সঙ্গে এই বিষয়ে রীতিমতো বিরোধ রয়েছে মধ্যভারতের মানুষের। মহাভারতের কাহিনিকে তুলে এনেই তাঁরা দাবি করেন, ছট পুজোর শুরুটা মধ্যভারত থেকেই। বনবাসী পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য তখন যতুগৃহের পরিকল্পনা করেছেন দুর্যোধন। যতুগৃহ থেকে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পারলেও পাণ্ডবদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। আর এই সময়েই পাঁচ স্বামীর মঙ্গলকামনায় সূর্যের আরাধনা করেছিলেন দ্রৌপদী। কিছু কাহিনিতে আবার বলা হয়, দ্রৌপদী নন। যতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার খবর জানতে পেরে হস্তিনাপুরে কুন্তীই সন্তানদের মঙ্গলকামনায় সূর্য পূজার বন্দোবস্ত করেন।

আবার উত্তরভারতের সমস্ত লোকাচারের সঙ্গেই যেমন রামায়ণের কাহিনির যোগ খুঁজে পাওয়া যায়, ছট পুজোর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। বলা হয়, ১৪ বছরের বনবাস কাটিয়ে দীপাবলির রাতে অযোধ্যায় ফিরেছিলেন রামচন্দ্র। আর ঠিক তার ৬ দিন বাদে তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হন। শুরু হয় রামরাজত্বের। আর দীপাবলির ৬ দিন বাদেই অনুষ্ঠিত হয় ছট পুজোর মূল অনুষ্ঠানও। বলা হয়, এইদিন সীতা নিজেই ব্রত পালন করে সূর্যের আরাধনা করেছিলেন। আর সেই পূজার প্রসাদ হিসাবেই এরপর তিনি লব এবং কুশের মতো বীর পুত্র লাভ করেছিলেন।

আরও পড়ুন
পুজোর পার্টি, ভাতি অথবা চারদিনের প্রেম

তবে এরপরেও এ-কথা মানতেই হয়, ছট পুজো কিন্তু সূর্যের আরাধনা নয়। বরং তা সূর্যের বোন কাত্যায়নীর আরাধনা। ছট শব্দটির সঙ্গে রৌদ্রের সম্পর্ক ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে খুব প্রাচীন নয়। বরং ভোজপুরি ভাষায় ছট শব্দের অর্থ ছয়। ষষ্ঠী তিথির কথা মাথায় রেখেই এই নাম। ঋগ্বেদের যুগ থেকেই ষষ্ঠী তিথিটিকে দেবী কাত্যায়নীর তিথি বলে মনে করা হয়। এমনকি ষষ্ঠী দেবী নামেও তিনি নানা জায়গায় পরিচিত। বাংলাতেও সন্তানের মঙ্গলকামনায় মায়েদের ষষ্ঠীর ব্রত রাখার রীতি বহু প্রাচীন। তবে সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। ছট পূজার ক্ষেত্রে এই দেবী কাত্যায়নীর নাম হয়ে যায় ছটি মাইয়া। প্রসাদের থালাতে যে প্রতিমূর্তিটিকে স্নান করানো হয়, তাও ছটি মাইয়ার। সূর্যের নয়। ছট পূজাও তাই মাতৃশক্তির আরাধনা। কালক্রমে তার মূল চেহারাটা কেবল বদলে গিয়েছে।

আরও পড়ুন
পুজোর রেশ কাটতেই 'অন্তর্ধান' ঘোষণা - কবে ঘুচবে রহস্য?

তাছাড়া ছট পূজাকে ঘিরে সবচেয়ে প্রাচীন কিংবদন্তিটির সঙ্গে জড়িয়ে নেপালের উল্লেখ। পুরাণের কাল্পনিক সরস্বতী সভ্যতার উল্লেখ সেখানে পাওয়া যায় না। এই নেপাল থেকেই পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটেছে। তার আগেও নানা উপসম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটেছে নেপালে। এই উপসম্প্রদায়গুলিও ছিল মূলত মাতৃউপাসক। বৌদ্ধ ধর্মের সময়ে তাঁদেরই প্রথম একজোট করা হয়েছিল। আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদের আদি দেবতাদেরও একজন সূর্য। ছট পুজোর মন্ত্রের মধ্যেও থেকে গিয়েছে ঋগ্বেদের সূর্য উপাসনার নানা শ্লোক। ভূগোলের নিয়মে সেই মন্ত্রও আবার বদলে বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে ছট পুজোকে ঘিরে থাকা কিংবদন্তি। পুজোর নামও কোথাও ছট, কোথাও আবার ছটি মাইয়া পূজা। আবার নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে মূলত রবি ষষ্ঠী বা সূর্য ষষ্ঠী নামেই পরিচিত দিনটি। তবে এমনই নানা বৈচিত্রের মধ্যে মিল একটি জায়গাতেই। ছট পুজোর দিন মানুষ সন্তানের মঙ্গলকামনায় ব্রত পালন করেন। এই সন্তান যেমন নিজের গর্ভজাত সন্তান, তেমনই তা এক সুন্দর ভবিষ্যতের কল্পনাও। আর ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখতে পেগানরা তো বরাবরই প্রকৃতির শরণ নিয়েছেন। ছটি মাইয়া বা দেবী কাত্যায়নী তেমনই এক কল্পনা, হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও যিনি সেই সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নটিকে বাঁচিয়ে রাখেন।

আরও পড়ুন
পুজোয় শিলিগুড়ির মহিলাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত গড়ল ‘তেজস্বিনী’

Powered by Froala Editor

More From Author See More