‘বেঁটে’ নেপোলিয়ন এবং কার্টুনিস্ট জেমস গিলরে-র গল্প

তিনি ‘ফরাসি বিপ্লবের বরপুত্র’। ফ্রান্সের সম্রাট হিসেবে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি। তাঁকে নিয়ে তৈরি হওয়া গল্পও কম নয়। তার মধ্যে একটি প্রচলিত ‘মিথ’ হচ্ছে, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonaparte) নাকি বেঁটে ছিলেন। উচ্চতায় কম হওয়া দোষের কিছু নয়, কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বীরত্বের সম্মানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকত উচ্চতার প্রশ্নও। যে কারণে নেপোলিয়নের নাম হয়ে যায়, ‘লে পেটি কর্পোরাল’ বা খুদে কর্পোরাল। এমনকি বেঁটে মানুষদের আক্রমণাত্মক ও ক্ষমতালোভী চরিত্র বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে ‘নেপোলিয়ন কমপ্লেক্স’ জাতীয় শব্দ। কিন্তু সত্যিই কি খর্বকায় ছিলেন তিনি? 

পরবর্তীকালের গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁর উচ্চতা ছিল ৫ পিয়েডস ২ পৌসেস। অবশ্য এই পরিমাপ ফরাসি হিসেবে। ইংরেজি মাপে তাঁর উচ্চতা দাঁড়ায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। উনিশ শতকের ফরাসি জনগণের গড় উচ্চতা ছিল এর থেকে কম। সেই হিসেবে তো তথাকথিত ‘বেঁটে’ বলা যায় না নেপোলিয়নকে। অনেকে বলেন ৬ ফুট উচ্চতার দেহরক্ষীদের নিয়ে সবসময় ঘুরতেন বলে খর্বকায় দেখাত তাঁকে। কিন্তু এই ‘গুজব’-এর পিছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল ইংল্যান্ডের। তাঁর ‘সম্মানহানি’ করার জন্য উচ্চতা নিয়ে এক দীর্ঘ প্রোপাগান্ডা চালিয়ে ছিল ইংল্যান্ডের তৎকালীন মিডিয়া। আর সেই প্রসঙ্গেই উঠে আসে ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট জেমস গিলরে-র (James Gillray) কথা। মূলত তাঁর একার কলমের জোরেই ‘বেঁটে’ বলে খ্যাত হয়েছিলেন নেপোলিয়ন। 

প্রথম দিকে অবশ্য ততটা ব্যঙ্গাত্মক ছিলেন না গিলরে। ১৭৯৮ সালে ‘নীলনদের যুদ্ধ’-এ ইংরেজ সেনাপতি হোরেশিও নেলসন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয় ফরাসি রণতরী। নেপোলিয়ন তখন রাজা হননি। কিন্তু এই পরাজয়ের সূত্র ধরেই প্রথম কার্টুন তৈরি গিলরের। রক্তমাখা তলোয়ার হাতে উদ্ধত নেপোলিয়ন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না হারের গ্লানি। পরের যুদ্ধে নেলসনকে হারাবেন, এরকম প্রতিজ্ঞা নিচ্ছেন। তিনি এখানে বদমেজাজি, অহংকারী হলেও, ‘বেঁটে’ নন। তবে এই ছবি ঝড়ের সূত্রপাত মাত্র। পরের কার্টুনটি এল ১৮০৩ সালে। যার নামের বাংলা সারমর্ম হতে পারে এরকম, ‘খুদে উন্মাদের উদ্দাম নৃত্য’। প্যারিসের তুইলেরির প্রাসাদে ইংরেজ কূটনীতিবিদদের সঙ্গে নেপোলিয়নের বাকবিতণ্ডার সত্যি ঘটনা নিয়ে আঁকা হয় ছবিটি। যার মাঝখানে ছোটো শিশুর মতো ‘পাগলামি’ করছেন নেপোলিয়ন। একদিকে উলটে পড়ে আছে সিংহাসন আর গ্লোব। অন্যদিকে টেবিল। মাঝে ছড়িয়ে অসংখ্য কাগজপত্র। আর রাগের মাথায় বলা নেপোলিয়নের কথাগুলি ‘বাবল’-এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দুদিকে। ফ্রান্সের বাইরে অত্যন্ত জনপ্রিয় হল এই কার্টুন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গিলরে-র দেওয়া ‘লিটল বনি’ নামটি। আর সেই থেকেই সূত্রপাত হল এক অবাধ্য বাচ্চার সঙ্গে নেপোলিয়নের চরিত্রের তুলনা।

এখানেই থামলেন না গিলরে। ১৮০৫-এ আঁকা ‘দ্য প্লাম্ব-পুডিং ইন ডেঞ্জার’ কার্টুনটিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কার্টুন বলে ধরা হয়। যেখানে দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ও নেপোলিয়ন খাবার টেবিলে একটি ভূগোলককে তলোয়ার দিয়ে ভাগ করছেন। পিট সাহেব যতটা লম্বা, ঠিক ততটাই ক্ষুদ্রাকার দেখানো হয়েছে ফরাসি সম্রাটকে। তার মধ্যে ইংরেজ ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে কেটে নিয়েছেন বড়ো অংশটি। আর বিরক্ত সহকারে নেপোলিয়ন তখনও চেষ্টা চালাচ্ছেন ছোটো অংশটি কাটার। এরপর ১৮০৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘টিডি ডল’ নামের আরেকটি কার্টুন। বেঁটে-খাটো নেপোলিয়ন এখানে চিরাচরিত রাজার পোশাকে কাজ করছেন একটি কেক তৈরির কারখানায়। আসলে চলছে গোটা ইউরোপকে আগুনের আঁচে পোড়ানোর প্রস্তুতি। এই ‘টিডি ডল’ নামটি নিয়ে এতটাই জলঘোলা হয় যে স্বয়ং নেপোলিয়ন পত্র পাঠান ইংরেজ সরকারকে। অবিলম্বে যেন এইসব কার্টুনকে নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই, ব্রিটিশ সরকার এই আবেদনে কানই দেয়নি। 

আরও পড়ুন
১০ ঘণ্টার দুই অর্ধে পুরো দিন, ফ্রান্সে চালু হয়েছিল যে-ঘড়ি

অন্যদিকে গিলরে-র কার্টুন জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। তাঁর পথ ধরেই আরো অসংখ্য শিল্পী শুরু করেন নেপোলিয়নের ক্যারিকেচার তৈরি করা। যার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ১৮১১ সালে এক অজানা শিল্পীর কার্টুন। যেখানে সবদিক থেকে ভেঙে পড়ছে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য। আর দুঃস্বপ্নে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নরকের দৈত্য-দানবদের থেকে। এর কয়েকবছর মধ্যে সত্যিই সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ১৮১৫-তে ফিরে এলেও ভয়ানকভাবে বিধ্বস্ত হন ওয়াটারলুর যুদ্ধে। জীবনের বাকি ছ’বছর কাটে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে। আর তারপরের বহু যুগ ধরে নেপোলিয়নের গায়ে সেঁটে রইল ‘বেঁটে’ তকমা। শুধু বন্দুক-তলোয়ারে নয়, তাঁকে হারতে হয়েছিল এক কার্টুনিস্টের তুলি-কলমের কাছেও। মৃত্যুকালে এই আক্ষেপও ছিল, সারা ইউরোপের সেনাবাহিনী তাঁর মর্যাদার যে ক্ষতি করতে পারেননি, তা একা করে দিয়েছিলেন জেমস গিলরে।

আরও পড়ুন
রাজপথে টহল জুলিয়াস সিজারের! ফরাসি বিপ্লবে অবাক-করা দৃশ্যের সাক্ষী ছিল ফ্রান্স

Powered by Froala Editor