জীবনের শেষ বারোটা বছর বিহারের বৈশালীতেই কাটিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বিহারের পথে পথে সে-সময় ধর্মপ্রচার করে বেড়াতেন তিনি। সঙ্গে থাকতেন আরও কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। তাঁরা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে বেড়াতেন প্রকাণ্ড এক পাথরের ভিক্ষাপাত্র। দিনের শেষে শিষ্যদের থেকে ভিক্ষা হিসাবে যে দানাশস্য মিলত, তা দিয়েই পেট ভরত বৈশালী মঠের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের। গৌতম বুদ্ধেরও।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো সেই ভিক্ষাপাত্রই এখন অস্তিত্বের সংকটে। এতদিন পর্যন্ত কাবুল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ছিল সেই পাথরের তৈরি প্রকাণ্ড পাত্রটি। যার ব্যাস ৫.৭ ফুট। গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর এখন তালিবানদের কবজায় ঐতিহাসিক ভিক্ষাপাত্র। যাতে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের স্পর্শ লেগে আছে বলেই বিশ্বাস প্রত্নতাত্ত্বিকদের। তালিবান শাসনে এমন একটি ঐতিহাসিক সম্পদ নিরাপদ নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ভারত থেকে এই ভিক্ষাপাত্র আফগানিস্তানে পৌঁছাল কীভাবে?
এই প্রশ্নের পিছনেই লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। যার উত্তর সন্ধানে ফিরে যেতে হবে সেই বৈশালীতেই। মহাপরিনির্বাণের আগে বৈশালী থেকে কুশীনগরের দিকে যাত্রা করেছিলেন তথাগত। তবে যাওয়ার আগে সবুজাভ-কালো বেলে পাথরের তৈরি পাথরের পাত্রটি তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন বৈশালীর শিষ্যদের। বৈশালী মঠেই সেটি সংরক্ষিত ছিল পরবর্তী প্রায় পাঁচশো বছর। প্রথম শতাব্দীতে কণিষ্ক পাটলিপুত্র দখল করার পর, পাথরের তৈরি পাত্রটি নিয়ে যান পুরুষপুর অর্থাৎ, বর্তমান পেশোয়ারে।
পেশোয়ারের একটি মঠে পাত্রটি সংরক্ষিত ছিল নবম শতাব্দী পর্যন্ত। হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন-সহ একাধিক চৈনিক পরিব্রাজকদের লেখাতেও উল্লেখ পাওয়া যায় বুদ্ধের এই ভিক্ষাপাত্রের কথা। নবম শতাব্দীর পর থেকে ধীরে ধীরে পেশোয়ারে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে ইসলাম ধর্ম। তারপর একাদশ শতকে মহম্মদ গজনীর আক্রমণের পর পেশোয়ারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বৈদেশিক শক্তির হাতে। বৃহত্তরভাবে ইসলামে ধর্মান্তরণও শুরু করেন গজনী। ভিক্ষাপাত্রের গায়ে সেই সময়ই অক্ষরিত হয়েছিল কোরানের শ্লোক।
আরও পড়ুন
১ মাসে তৈরি ৪০ কিলোমিটার কাঁটাতার, আফগান-পরিস্থিতিতে অমানবিক গ্রিস
তবে কোরানের সেই শ্লোকই ত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রটির। পরবর্তীতে একাধিক ধর্মযুদ্ধের সাক্ষী হলেও, পাত্রটির গায়ে আঁচড় পড়েনি কোনো। তার অন্যতম কারণ হল পাত্রের গায়ে উভয় বৌদ্ধ এবং ইসলাম ধর্মের চিহ্ন লেগে থাকা। দ্বাদশ শতকের শুরুর দিকে পাত্রটিকে তৎকালীন শাসক সরিয়ে নিয়ে যায় আফগানিস্তানে। কান্দাহারের জামিয়া মসজিদে পাত্রটি ব্যবহৃত হত ইসলাম ধর্মালম্বীদের ওয়াজু হিসাবে। জামিয়ায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী সন্তদের হাত ধোয়ার পবিত্র জল রাখা হত এই পাত্রটিতেই।
আরও পড়ুন
শরীর অর্ধেক পুঁতে, ইট ছুঁড়ে হত্যা; ভয়াল স্মৃতি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের আফগানদের
১৯৮০-র দশকে গৃহযুদ্ধের সময় আফগানিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহ যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে পাত্রটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন কাবুল মিউজিয়ামে। তবে মৌলবাদী শক্তিকে অবশ্য ঠেকিয়া রাখা সম্ভব হয়নি আফগান সরকারের। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েই সমগ্র আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবানরা। ধ্বংস করে ফেলে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী। যার মধ্যে ছিল বামিয়ানের ঐতিহাসিক বুদ্ধমূর্তিটি। কাবুল মিউজিয়ামেও চলেছিল ধ্বংসযজ্ঞ। তবে কোরানের শ্লোকের জন্যই রক্ষা পেয়েছিল বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্রটি।
আরও পড়ুন
তালিবান জমানায় কোথায় আছেন বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য আফগান গার্ল’?
২০১৪ সালে পাত্রটি ফেরানোর উদ্যোগ নেন ভারত সরকার। বিশিষ্ট ভারতীয় প্রত্নবিদ ও কলকাতার আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর ফণীকান্ত মিশ্রকে সেসময় পাঠানোও হয়েছিল কাবুল মিউজিয়ামে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি নিশ্চিত করেছিলেন কাবুল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত পাত্রটির জন্ম হয়েছিল বিহারেই। আড়াই হাজার বছর আগে। কারণ, হালকা ওজনের সবুজাভ-কালো বেলেপাথর ভারতের উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার ছাড়া আর কোথাওই পাওয়া যায় না।
২০১৪ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল পাত্রটি ভারতে স্থানান্তরিত করার প্রশাসনিক কর্মসূচি। তবে সেই কাজ দীর্ঘদিন ধরেই আটকে ছিল লাল সুতোয় গেরোয়। সেই জট কাটার আগেই ফের আফগানিস্তানের দখল নিল তালিবানরা। তালিবান রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর, ঐতিহাসিক এই পাত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত প্রত্নতাত্ত্বিকরা। যদিও তালিবানরা আশ্বাস দিয়েছে, আগের মতো অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে না তারা। কিন্তু আদৌ কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেই আশ্বাস? বামিয়ান বুদ্ধ ধ্বংসের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে ঘটবে না, সেই কথা হলফ করা বলা দুষ্কর কাজ। এমন সংকটকালে দাঁড়িয়ে দ্রুত ভারতে ফেরানোর ব্যবস্থা হোক বুদ্ধের স্পর্শধন্য প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীটিকে, সেই আর্জিই করছেন ঐতিহাসিকরা…
তথ্যসূত্রঃ
১. Do you know what happened to Lord Buddha's bowl?, Akash Deep Ashok, India Today
২. The Buddha's Begging Bowl, Shravasti Dhammika, Sdhammika Blogspot
৩. Biography of Gautama Buddha, Diya Bati, Hindijivanparichya Blogspot
Powered by Froala Editor