ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে এক শিল্পী হেঁটে যাচ্ছিলেন নদীর সেতুর উপর দিয়ে। অস্তগামী সূর্য তখন দিনের সমস্ত রং শুষে নিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। শেষ বিকালের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের মধ্যে। মেঘ দেখে মনে হচ্ছে যেন আকাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আর সমস্ত প্রকৃতি যেন এক অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠছে। ঠিক এভাবেই জন্ম নিয়েছিল শিল্পের ইতিহাসে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক ছবি। ইংরেজি ভাষায় যে ছবির নাম 'দ্য স্ক্রিম'। আর শিল্পী ইউরোপের ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন, এডওয়ার্ড মুঙ্ক।
'দ্য স্ক্রিম' ছবিটি যে শিল্পকলার ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ, একথা নতুন করে বলার কিছু নেই। অর্থমূল্যের হিসাবেও পৃথিবীর পঞ্চম দামি ছবি এটি। স্বাভাবিকভাবেই এই ছবির সংরক্ষণের ব্যাপারে চিন্তিত পৃথিবীর প্রতিটি মিউজিয়াম। এর মধ্যেই ২০০৪ সালে ছবিটি চুরি হয়ে যায়। দুবছর পর সেটি আবার উদ্ধার করা হলে স্থান পায় নরওয়ের অসলো শহরের মুঙ্ক মিউজিয়ামে। কিন্তু যত দিন যেতে থাকে, মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ তত গভীর হতে থাকে। চুরি যাওয়ার পরে ছবিটির যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু তার পরে যে ঘটনা ঘটতে থাকে, তা আরও রহস্যময়। ছবিটির মধ্যে মানুষের শরীরে এবং মেঘের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু জায়গায় হলুদ রঙের ব্যবহার করেছিলেন শিল্পী। কিন্তু ক্রমশ সেই হলুদ রং ফিকে হয়ে আসতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে সাদা রঙে পরিণত হয়।
'দ্য স্ক্রিম' ছবিটি নষ্ট হয়ে গেলে শিল্প জগতের যে ক্ষতি ঘটবে, সেব্যাপারে চিন্তিত প্রত্যেকেই। তাই খুব তাড়াতাড়ি একদল সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ গবেষণা শুরু করেন। প্রথমে কারোর কারোর সন্দেহ হয়েছিল, চুরি যাওয়ার পর যে ছবিটি উদ্ধার হয়েছে সেটি বুঝি আসল নয়। কিন্তু সেই সন্দেহও অমূলক প্রমাণিত হয়। ছবি সংরক্ষণের জন্য নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে। প্রদর্শনীও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই কোনো সুরাহা হয়নি।
অবশেষে এই হলুদ রঙের রহস্য ভেদ করলেন গবেষকরা। ফ্রান্সের সিংক্রট্রন রেডিয়েশন ফেসিলিটির সহযোগিতায় মোবাইল ল্যাবরেটরির গবেষকরা বুঝতে পারলেন ছবিতে ব্যবহৃত হলুদ রঙটি আসলে ক্যাডমিয়াম সালফাইড। আর ক্লোরাইড বাষ্পের সংস্পর্শে এসে সেটি ক্যাডমিয়াম ক্লোরাইডে পরিণত হচ্ছে। আর এর ফলেই হলুদ রং ফিকে হয়ে আসছে। এবং আশার কথা, এই ক্লোরাইড বাষ্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো প্রযুক্তি সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের কাছে আছে।
তবে এর মধ্যে আরেকটি কাজ করতে হবে। সেটি হল হারিয়ে যাওয়া রং পুনরুদ্ধার করা। সেই কাজটিও গবেষকরা শুরু করে দিয়েছেন। কৃত্রিমভাবে তৈরি ক্যাডমিয়াম সালফাইড দিয়ে একটি প্রাথমিক আস্তরণ দিয়ে তার উপর তাঁরা চড়িয়েছেন শিল্পীর নিজস্ব রঙে টিউব থেকে পাওয়া পুরনো রঙের ফ্লেক। আর এভাবেই হয়তো আবার প্রাণ ফিরে পেতে চলেছে 'দ্য স্ক্রিম'।
রঙ হারানোর রহস্যের তো সমাধান হল। এক অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল শিল্পের ইতিহাস। আর শিল্প আমোদি মানুষরাও তাই অপেক্ষায় রয়েছেন। এবার হয়তো আবার প্রদর্শনীতে স্থান পেতে চলেছে ইতিহাস তৈরি করা এই ছবি।