শূন্যে ভাসমান স্তম্ভ ও অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাচীন মন্দিরের ‘রহস্য’

বেশ কয়েকদিন আগে একটি বিশেষ ছবি নেট দুনিয়ায় জায়গা করে নিয়েছিল। ছবিটি একটি বড়ো থামের। ঈষৎ ধূসর এই থামটির গায়ে খোদাই করা সুন্দর সব কারুকাজ। আকর্ষণীয় তো বটেই; তবে আসল দৃশ্য ওখানে নেই। রয়েছে থামের একদম নিচে। এবারই চমক লাগবে আপনার। এক ঝলক দেখেই মনে হবে, থামটি যেন সম্পূর্ণ নয়। নিচের একটু জায়গা ফাঁকা। ঠিক যেন ঝুলন্ত থাম! থামের সেই ফাঁকা জায়গাটি সত্যিই ফাঁকা কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখছেন কয়েকজন। একটি পাতলা লাল কাপড়কে ওখানে রেখে দেখার চেষ্টাও করছেন। এবং অদ্ভুত ব্যাপার! কাপড়টিও থামের তলা দিয়ে দিব্যি গলে যাচ্ছে। এমন ঝুলন্ত থামের রহস্যটা কী? কোথায় আছে এমন মন্দির?

গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে যাওয়া যাক অন্ধ্রপ্রদেশে। ইতিহাসের দেশ ভারতবর্ষ। আর সেই ছোঁয়া এসে পড়েছে অন্ধ্রতেও। একটা সময় নিজামের শাসন দেখেছে এখানকার মানুষ, আর তারও আগে দেখেছে বিজয়নগর সাম্রাজ্য। আর সেই অধ্যায়েরই একটি অংশ হল লেপাক্ষীর বীরভদ্র মন্দির। গ্রামটি ছোট্ট হলেও ইতিহাসের কোলে বেড়ে উঠেছে। নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই মাহাত্ম্য। তেলেগু ভাষায় ‘লেপাক্ষী’ শব্দের অর্থ হল উড়ন্ত পাখি। প্রচলিত আছে, রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে নিয়ে পুষ্পক রথে চড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সেখানে হাজির হন জটায়ু। আকাশপথের সেই যুদ্ধে রাবণের কাছে পরাজিত ও গুরুতর আহত হয়ে এই গ্রামেই এসে পড়েন জটায়ু। সেখান থেকেই এই নাম… 

পুরাণ থেকে একটু সরে আসা যাক ১৬শ শতকে। তখন দক্ষিণ ভারতে প্রবল বিক্রমে রয়েছে বিজয়নগর সাম্রাজ্য। মসনদে রাজা অচ্যুতদেবরায়। সেই সময় তাঁরই নির্দেশে পেণুকোণ্ডার বীরুপান্না ও বীরান্না মিলে তৈরি করেন এই বিশেষ মন্দির। লেপাক্ষী গ্রামেই শুরু হয় নির্মাণকাজ। প্রকৃতপক্ষে শিবের মন্দির এটি। মহাদেবেরই এক অবতার বীরভদ্র এখানে পূজিত হন। তবে এর বাইরে গিয়েও মন্দিরের নকশা, তার গায়ের কারুকাজ ও স্থাপত্য ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকেই সামনে নিয়ে আসে। গোটা পৃথিবী থেকে এখানে পর্যটকেরা আসেন। আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন এই স্থাপত্যের দিকে… 

মূল মন্দিরের বাইরের অংশেই রয়েছে নাটমন্দির। আর এখানেই আমাদের প্রধান আকর্ষণের অবস্থান। ঢুকলেই প্রথমে নজর কাড়বে সুবিশাল ৭০টি থামের কারুকাজ। ঘুরতে ঘুরতে চোখ থামবে একটি বিশেষ থামের দিকে। হ্যাঁ, এটাই আমাদের সেই ঝুলন্ত স্তম্ভ। নাটমন্দিরের একটু কোণের দিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে এটি। ঠিক নিচের একটু জায়গা একেবারে ফাঁকা! থামটি সম্পূর্ণ করা হয়নি কোনো কারণে? নাকি এর ভেতরে রয়েছে দুরূহ কোনো যোগাযোগ? সঠিকভাবে কিছুই জানা যায় না। তবে স্থানীয় কিংবদন্তি বলে, লেপাক্ষীর বীরভদ্র মন্দিরের এই বিশেষ থামটির ভেতরেই নাকি এখানকার যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে!… 

কী এমন রহস্য? এটা খুঁজতেই একবার এসেছিলেন এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার। তখনও স্বাধীন হয়নি দেশ। এই বিশেষ স্তম্ভটি নিয়ে তাঁরও উৎসাহ ছিল প্রচুর। রহস্য ভেদ করতে আট ফুট উঁচু স্তম্ভটির তলায় লোহার রড ঢুকিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারপরেই ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। গোটা মন্দিরটাই যেন দুলতে শুরু করল! শুধু তাই নয়, সবকটা থামই নড়তে লাগল। আর মন্দিরের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসতে লাগল। পাছে মন্দির ভেঙে পড়ে, সেইজন্য তড়িঘড়ি সেই জায়গা থেকে পালালেন ওই ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার। তবে রহস্য তো দূর হলই না; বরং আরও বেড়ে চলল… 

আরও পড়ুন
বয়স প্রায় ১৩০০০ বছর, বিশ্বের ‘প্রাচীনতম’ মন্দির রয়েছে তুরস্কে

স্রেফ এর টানেই আরও পর্যটক হাজির হন বীরভদ্র মন্দিরে। পুরাণ, ইতিহাস আর রহস্যের এমন ঘনঘটা আর কোথায় পাওয়া যাবে! ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরাও গবেষণা চালিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে আখেরে লাভ কিছুই হয়নি। গবেষকরা মনে করেন, হয়ত এই বিশেষ থামই সমগ্র মন্দিরের ভরকেন্দ্র ধরে রেখেছে। আবার কয়েকজন মনে করেন, এই থামগুলি ভূমিকম্পের হাত থেকে মন্দিরকে রক্ষা করেছে। কারণ যাই হোক, তাতে রহস্য কমে না এতটুকুও। সুযোগ হলে একবার ঘুরে আসতেই পারেন অন্ধ্রপ্রদেশের লেপাক্ষী গ্রামে। দিনের শেষে আপনিও এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘The Hanging Pillar of Lepakshi Temple’, Kaushik Patowary, Amusing Planet
২) ‘What is the mystery behind the hanging pillar of Lepakshi temple?’, Ashish Gupta, Medium

আরও পড়ুন
১৫০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে ধ্বংসের দিন গুনছে চন্দ্রকোণার শীতলা মন্দির

Powered by Froala Editor