পাথুরে উপত্যকার বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মরিস কাউলি। অদূরেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে খরস্রোতা ঝর্ণা। হ্যাঁ, এই গাড়িটিরই অনুসন্ধান চলছিল এতক্ষণ। গাড়িটি দেখামাত্র ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। গাড়িতে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল একটি স্যুটকেস, কিছু জামা-কাপড় এবং একটি মেয়াদোত্তীর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স। তাতে লেখা অগাথা ক্রিস্টি। কিন্তু কোথায় তিনি? এই জনমানবহীন প্রান্তরে কোনো চিহ্নমাত্রই নেই তাঁর। তবে কি…
অগাথা ক্রিস্টির (Agatha Christie) নামের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছে রহস্য (Mystery)। মার্ডার অন দ্য ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, মার্ডার অফ রজার অ্যাক্রয়েড, ডেথ অন দ্য নাইলের মতো কিংবদন্তি উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন রহস্য-রানি। গিনেস বুকও তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রিত কথাসাহিত্যিক হিসাবে। তবে উপন্যাসের পাতা থেকে রহস্যের মায়াজাল ঢুকে পড়েছিল তাঁর জীবনেও। এই প্রতিবেদনের শুরুতেই যে দৃশ্যপটের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা কোনো উপন্যাস বা সাহিত্যের অংশ নয়। খোদ রহস্য লেখিকার অনুসন্ধানে রাতদিন এক করেছিল ব্রিটেনের পুলিশ। প্রথম থেকে সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং।
দিনটা ছিল ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। রাতে নিয়মমাফিক কন্যা রোসালিন্ডের ঘরে গিয়েছিলেন তাঁকে। কপালে এঁকে দিয়েছিলেন স্নেহের চুম্বন। তারপর গুডনাইট জানিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন সেখান থেকে। মিনিট দশেক পর বিছানায় শুয়ে শুয়েই গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ পেয়েছিলেন রোসালিন্ড। তখন বছর সাতেক বয়স তাঁর। শিশুর সহজ-সরল মন ধরে নিয়েছিল কোনো জরুরি দরকারে বাইরে যাচ্ছেন তাঁর মা। অতশত না ভেবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রোসালিন্ড। তবে পরদিন সকালেও যখন ফিরলেন না অগাথা, তখন ক্রমশ চড়তে থাকল চিন্তার পারদ।
দু’দিন কেটে যাওয়ার পর, বাধ্য হয়েই পুলিশের দপ্তরে হাজির হয়েছিলেন অগাথার স্বামী আর্চি ক্রিস্টি। মিসিং ডায়েরি লেখানো হয় অগাথার নামে। কিন্তু এমন খবর কি চেপে রাখা যায়? আগুনের মতোই তা ছড়িয়ে পড়ল ব্রিটিশ মিডিয়ায়। এমনকি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতাজুড়ে বড়ো বড়ো করে বেরল অগাথার অন্তর্ধানের সংবাদ। কিন্তু কোথায় উধাও হয়ে গেলেন তিনি?
আরও পড়ুন
বিশ্বের ইতিহাসে ‘স্মার্টেস্ট’ ক্রিকেট টিম, দলে শার্লক এবং পিটার প্যান-স্রষ্টাও
অগাথার অনুসন্ধানে নেমেছিলেন প্রায় ১০০০-এরও বেশি পুলিশ অফিসার। সেইসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক হাত লাগিয়েছিলেন এই কাজে। বলতে গেলে, ব্রিটেনের ইতিহাসে এটিই এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো সার্চ অপারেশন। ঘটনাপ্রবাহের তৃতীয়দিনেই গিল্ডফোর্ডের কাছে নিউল্যান্ডস কর্নারে সন্ধান মেলে অগাথার গাড়ির। তবে তাতে যে খুব একটা লাভ হয়নি পুলিশের, সে-কথা বলা হয়েছে প্রথমেই। তবে গিল্ডফোর্ডের কাছে অগাথার গাড়ির অনুসন্ধান যেন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল পুলিশের কপালে।
আরও পড়ুন
গাছতলায় ‘মুঘল-এ-আজম’এর গান রেকর্ড; গানের পুস্তিকা লিখেছেন শার্লক হোমসও!
সে-সময় নিউল্যান্ডস ঝর্ণার কাছে সদ্য খনন করা হয়েছে প্রকাণ্ড এক কৃত্রিম জলাশয়। তখনও তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি পর্যটকদের কাছে। ফলে, জনমানবহীন এই প্রান্তর হয়ে উঠেছিল অপরাধীদের আস্তানা। অগাথার অন্তর্ধানের কয়েকদিন আগেই এই হ্রদে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল দুটি শিশুর মৃতদেহও। ফলে, অগাথার ঘটনাও যেন ইঙ্গিত দিচ্ছিল সেদিকেই। ডুবুরি নামানো হল হ্রদে। কিন্তু ব্যর্থ হল সেই অভিযান। শেষ পর্যন্ত অগাথা-রহস্যের তদন্তভার কাঁধে তুলে নিলেন ব্রিটেনের আরও এক কিংবদন্তি সাহিত্যিক— শার্লকস্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়াল। তখন তাঁর বই রীতিমতো পাঠ্য হিসাবে পড়ানো হচ্ছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।
আরও পড়ুন
কোনান ডয়েলের চেয়েও বেশি শার্লক-কাহিনি লিখতে চান এই মার্কিন লেখিকা!
কোনান ডয়াল শুধু তদন্তই নয়, একই সঙ্গে অগাথার অনুসন্ধানে তন্ত্রসাধনার পথেও হাঁটলেন। কোনান ডয়াল এবং তাঁর স্ত্রী— উভয়েই বিশ্বাস করতেন ব্ল্যাক ম্যাজিকে। তেমনই এক গুপ্তবিদ্যা বিশেষজ্ঞের কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। তাতে লাভ হয়নি কিছু। তবে এই ঘটনার পরেই রহস্যজনকভাবে মোড় নেয় পরিস্থিতি। উঠে আসে একাধিক সম্ভাবনা, অভিযোগ ও জল্পনা। যার কেন্দ্রে ছিল অগাথার স্বামী আর্চি। আর্চি ছিলেন রয়্যাল ফ্লাইং কর্পসের পাইলট। বিবাহের ঠিক পর পরই তাঁকে বাড়ি ছেড়ে হাজির হতে হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে। যখন ফিরলেন যখন বাড়িতে ফেরেন তিনি, তখন অনেকটাই দূরত্ব বেড়ে গেছে অগাথার সঙ্গে। অন্যদিকে অগাথা তখন রীতিমতো নাম করে ফেলেছেন সাহিত্যজগতে। বেড়েছে ব্যস্ততাও। অন্যদিকে এইসময় সেক্রেটারি ন্যান্সি নীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর্চির। অগাথার থেকে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়েছিলেন আর্চি। প্রকাশ্যে আসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তা নিয়েই ঝগড়া হয়েছিল ক্রিস্টি দম্পতির। স্বাভাবিকভাবেই এর পর খুনের অভিযোগ ওঠে আর্চির দিকে। যদিও কোনো প্রমাণ না থাকায় তখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি তাঁকে।
অগাথার অন্তর্ধানের ১১ দিনের মাথায় ঘটে আরও এক আশ্চর্য ঘটনা। হঠাৎ করেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফোন আসে হ্যারোগেটের এক হোটেল থেকে। হোটেলের এক ওয়েটার এবং ব্যাঞ্জোবাদক দাবি করেন, বিগত ১১ দিন ধরেই সেখানে রয়েছেন অগাথা ক্রিস্টি। এমনকি প্রতি সন্ধেবেলায় তিনি হাজির হন বল ড্যান্স ফ্লোরে। ব্যাপারটা বিশ্বাস্য না হলেও, ঘটনাস্থলে ছুটে যায় পুলিশ বাহিনী। সঙ্গে ছিলেন অগাথার স্বামী আর্চিও। গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে যান তাঁরা। হ্যাঁ, অগাথাই বসে আছেন হোটেলের ডাইনিং-এ। হাতে ধরা খবরের কাগজ। যার প্রথম পাতাতেই রয়েছে তাঁরই অন্তর্ধানের খবর!
আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রাথমিকভাবে তাঁকে তাঁর নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেননি অগাথা। নিজেকে ন্যান্সি নীল নামে পরিচয় দেন তিনি। এমনকি হোটেলের রেজিস্টারেও তিনি সই করেছিলেন এই নামেই। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দিকে ধেয়ে আসে একাধিক প্রশ্নবাণ। ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার পর পোশাক পরিবর্তনের অছিলায় হঠাৎই নিজের ঘরে চলে অগাথা। ফিরে আসেন মিনিট কুড়ি বাদে। বাড়ি ফেরার পর এই বিষয়ে আর মুখ খোলেননি তিনি। নিজের জীবনীতেও খুব বেশি উল্লেখ করেননি এই ঘটনার কথা। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল তাঁর?
অনেকের অভিমত, স্বামীকে অন্য নারীর সঙ্গে সহবাস করতে দেখে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন অগাথা। তাই আর্চিকে খুনের দায়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন তিনি। কারোর মতে, আকস্মিক শোকে মানসিক স্থিতি হারিয়েছিলেন তিনি। ন্যান্সি নীল হিসাবে নিজের পরিচয় দেওয়া, তারই অন্যতম কারণ। মনস্তাত্ত্বিকরা অনেকেই সায় দিয়েছিলেন এই তত্ত্বে। শোকের কারণে অ্যামনেশিয়া বা সাময়িক স্মৃতিভ্রংশের প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল একাধিক গবেষণায়। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়নি কিছুই। অগাথার মৃত্যুর পাঁচ দশক পর, আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে এই রহস্য…
Powered by Froala Editor