মধ্যযুগের ইউরোপে বেশ চর্চিত বিষয় ছিল অ্যালকেমি (Alchemy)। অবশ্য ইউরোপ বললে ভুল হবে, সুদূর অতীত থেকে পৃথিবীর প্রায় সবপ্রান্তেই কমবেশি চর্চা হয়েছে এই বিদ্যা নিয়ে। তবে মধ্যযুগে যেন হঠাৎ করেই বাড়বাড়ন্ত হয় অ্যালকেমির। ব্যবহারিক বিজ্ঞান, তন্ত্র, জাদুবিদ্যা সবই মিশে গেছে তার মধ্যে। গুজবও তৈরি হয়েছে প্রচুর। শুধু বিষয় নয়, বিষয়ীকে নিয়েও তৈরি হত অসংখ্য রহস্যজনক গল্পগাথা। ফ্রান্সের ফুলকানেলি (Fulcanelli) সেরকমই এক ব্যক্তি। কিন্তু এঁর কাজকর্ম মধ্যযুগে নয়, মাত্র একশো বছর আগেও ছিল তাঁর অস্তিত্ব। তারপর একদিন আচমকা গায়েব হয়ে গেলেন তিনি। কেউ কোনো খোঁজই পেল না আর।
কে এই ফুলকানেলি? কোথা থেকে তাঁর আগমন? সেটাও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। এমনকি নামটিও আসল নয়। ইতালীয় পুরাণে ‘ভালকান’ ছিলেন আগুনের দেবতা এবং ‘এল’ শব্দটি মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় ব্যবহৃত হত দেবতাদের রাজা বোঝাতে। সেই অর্থে ফুলকানেলি-র অর্থ দাঁড়াতে পারে ‘পবিত্র আগুনের দেবতা’। তাহলে কি তিনি ইতালি বা এশিয়ার লোক? উত্তর নেই। বরং একবার নাকি তাঁর পাসপোর্টে পাওয়া গেছিল স্পেনের স্ট্যাম্প। ফলে আসল নামের মতো তাঁর জাতিগত পরিচয় নিয়েও রয়ে গেছে হাজারো প্রশ্ন। অনেকে অবশ্য দাবি করেন যে ফরাসি পদার্থবিদ জুলেস ভায়োলেই আসলে ফুলকানেলি। আবার অনেকের মতে, চিত্রশিল্পী জুলিয়েন শ্যাম্পানেই নাম ভাঁড়িয়ে দুটি বই লিখে জনপ্রিয় হয়েছিলেন ফুলকানেলি নামে।
এরকম রহস্যজনক পরিচয় তো অনেকেরই থাকতে পারে। নাম ভাঁড়ানো কঠিন কিছু ছিল না সেই সময়ে। তাহলে ফুলকানেলির গুরুত্ব কোথায়? সেটা লুকিয়ে আছে তাঁর কয়েকটি বই আর দুয়েকজনের স্মৃতিতে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য মিস্টরিজ অফ ক্যাথিড্রালস’ ও ‘ড্যুয়েলিংস অফ এ ফিলোজফার’। বলা হয়, এই বইগুলিতে তিনি প্রাচীন অ্যালকেমির অনেক গুপ্তরহস্য সংকলিত করেছিলেন। নিজে হাতে পরীক্ষা করে নাকি সফলও হয়েছিলেন সেগুলিতে। যার মধ্যে ছিল সিসা থেকে সোনা তৈরির মতো অবিশ্বাস্য পরীক্ষা। অদৃশ্য হওয়ার রহস্যও কি তার মধ্যে ছিল? বলা যায় না। কিন্তু এই দুটি বই প্রকাশের পরেই ফ্রান্সের মানুষের নজরে আসে ফুলকানেলির নাম। ‘এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’স গ্লোরি’ নামের আরেকটি বইয়ের কাজও নাকি শুরু হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই ‘উধাও’ হয়ে যান ফুলকানেলি। অবশ্য ইউরোপের বৃহত্তর জনমানসে তিনি পরিচিতি লাভ করেন জ্যাক বারগিয়েরের ‘দ্য মর্নিং অফ দ্য ম্যাজিশিয়ান’ বইটি প্রকাশের পর। যেখানে ফুলকানেলির কাজকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল।
আর এই বারগিয়েরের সঙ্গেই ঘটেছিল এক আশ্চর্য ঘটনা। যিনি মূলত ছিলেন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করতে হয়েছে গুপ্তচর হিসেবেও। আবার, অ্যালকেমির মতো গবেষণাতেও আগ্রহ ছিল তাঁর। প্রচলিত যে, টিনটিনের ‘ফ্লাইট ৭১৪’ কমিকসের মিক কানরোকিটফ চরিত্রটি এঁর আদলেই তৈরি। ১৯৩৭ সালে তিনি পরমাণু শক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন বিখ্যাত ফরাসি বৈজ্ঞানিক আন্দ্রে হেলব্রোনারের সঙ্গে। হঠাৎই একদিন এক অচেনা ভদ্রলোক এসে তাঁকে সাবধান করেন পরমাণুর ভয়ানক শক্তি সম্পর্কে। তিনি নিজে নাকি এ বিষয়ে হাতে-কলমে গবেষণা করেছেন দীর্ঘদিন। এর মধ্যে যে প্রাণঘাতী ‘বোমা’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে, সে বিষয়েও সাবধান করে যান তিনি। আশ্চর্য! বাইরের কারো তো জানার কথা নয় এই গবেষণা সম্পর্কে। কে এই ভদ্রলোক? কোথায় যেন আগে দেখেছেন তাঁকে? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল ফুলকানেলির ছবির কথা।
আরও পড়ুন
পাওয়া যায় অভিযাত্রীদের ‘মাথা কাটা’ দেহ, আজও রহস্যে ঘেরা নাহানি উপত্যকা
বারগিয়েরের মতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর মুখ থেকে বেরোনো কথা উড়িয়ে দিতে পারল না কেউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার ‘স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিস’ থেকে একটা গোপন তদন্তও চালানো হয় এই আশ্চর্য অ্যালকেমিস্টের সন্ধানে। এরপরের ঘটনা ১৯৫৪ সালের। যখন ফুলকানেলি দেখা দেন তাঁর শিষ্য ইউজাঁ ক্যাঁসেলিতকে। শিষ্যের বর্ণনা অনুযায়ী রূপবদলের দক্ষতা অর্জন করেছিলেন গুরু। যা অ্যালকেমিচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাধনা। তারপর আর কোনোদিন সন্ধান মেলেনি ফুলকানেলির। একটা গুজব এই যে, তিনি দীর্ঘদিন স্পেনের কোনো গুপ্তস্থানে বসে গবেষণা চালিয়েছিলেন। এখনও করে চলেছেন বলে অনেকের বিশ্বাস। যাঁকে নিয়ে সিসা থেকে সোনা তৈরির মতো কিংবদন্তি আছে, তাঁকে নিয়ে এরকম গল্প তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন
‘ভূত’ হয়ে নিজেরই খুনের তদন্ত! আজও রহস্যে মোড়া এই কাহিনি
আসলে অ্যালকেমির মতো রহস্যে মোড়া বিদ্যা নিয়ে মানুষের আকর্ষণ দীর্ঘদিনের। আলো-আঁধারে ঘেরা তার চাবিকাঠি। গত শতকের ফ্রান্সে ফুলকানেলি হয়ে উঠেছিলেন এই বিদ্যার শেষতম প্রহরী। তাঁর ‘উধাও’ হয়ে যাওয়া রসদ জুগিয়েছিল কাহিনি তৈরিতে। যে কারণে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল আমেরিকাও। যাঁর নামের সঙ্গে পরমাণু শক্তির গবেষণা জড়িয়ে আছে, তাঁকে কি সহজে ছেড়ে দিতে পারে আমেরিকা? এই অতি উৎসাহই হয়তো জন্ম দিয়েছে গল্পের, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে কিংবদন্তি।
Powered by Froala Editor