বাংলার সাহিত্য জগতে শিবরাম আছেন শিবরামেই। শুধু সাহিত্য জগতে তো বটেই, জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও তিনি ‘সিদ্ধপুরুষ’। কোনো কিছুর ওপরই মোহ নেই; অভাব আছে, কিন্তু তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিন কাটানো— সিদ্ধপুরুষ ছাড়া কি কখনও সম্ভব! তার ওপর ‘শিব’ আর ‘রাম’ দুজনেই ভর করে আছেন তাঁর নামে। এহেন মানুষটি সিনেমার যাকে বলে একেবারে পোকা। সন্ধের সময় সিনেমা না দেখলেই নয়। এইরকমই একদিন সিনেমা দেখতে গেছেন শিবরাম চক্রবর্তী। হঠাৎই আলাপ আরেক তরুণের সঙ্গে। প্রেমেন্দ্র মিত্র। আগে তাঁর লেখা ‘পাঁক’ উপন্যাসটি পড়ে চিঠি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন শিবরাম। এবার একেবারে সামনাসামনি আলাপ! বন্ধুত্ব গাঢ় হতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। এমন হল যে সিনেমা হলে বসেই দুজনে জমিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। কী গল্প? না, বিশ্বভ্রমণের! দুই বন্ধুর এমন ‘ভ্রমণ বৃত্তান্তে’ আশেপাশের দর্শকরা রীতিমতো বিরক্ত। তাতে অত পাত্তা দিলে চলে নাকি হে? তাহলে যে ঘোরাটাই হবে না…
প্রেমেন্দ্র মিত্র আর শিবরাম চক্রবর্তী— বাংলা সাহিত্যের দুই কালজয়ী পুরুষের নাম। শুধু লেখায় নয়, এমন বন্ধুত্ব সচরাচর দেখা যায় না। সেই যে সিনেমা আর সাহিত্য এসে দুজনের হাত মিলিয়ে দিল, আর ছাড়াছাড়ি হল না। শিবরাম মানেই নিখাদ মজা; যেমন লেখায় তেমন জীবনে। নিজে যদিও বলেছিলেন, বড়ো হয়ে গেলে কেউ আর বন্ধু থাকে না; সবাই ‘এনিমি আর নন-এনিমি হয়ে যায়। নন-এনিমিদেরই আমরা বন্ধু বলে থাকি।’ কিন্তু প্রেমেন্দ্র’র বেলায় ব্যাপারটা একটু অন্য। ‘প্রেমেনের মতো মিত্র হয় না!’
সোনার খাতাখানি ভরে আছে অজস্র ঘটনায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পুতুল ও প্রতিমা’ উৎসর্গ করলেন বন্ধু শিবরামকে। দ্বিতীয় সংস্করণের একটি কপি পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দিলেন তাঁকে। শিবরাম তো মুগ্ধ! তাঁকে কেউ বই উৎসর্গ করবে, এমনটা ভবতে পারেননি। কিন্তু এবার আশ্চর্য হবার পালা প্রেমেন মিত্তিরের। সেকি, এখন জানল উৎসর্গের কথা? শিবরাম আরও বেশি অবাক। ‘দ্বিতীয় সংস্করণটা আমাকেই উৎসর্গ করেছ দেখলাম। কিন্তু প্রথমটা কাকে করলে?’ এরকমটা হয় নাকি কখনও? তাহলে প্রথম সংস্করণটা উল্টেও দেখেননি শিবরাম? তৎক্ষণাৎ উত্তর, প্রেমেনের সব লেখাই তো তাঁর পড়া। তার ওপর অনেকবার করে পড়া। তাই আর খোলা হয়নি। তবে মলাটটা খুবই সুন্দর হয়েছিল। ‘ভাবলাম প্রেমেন্দ্রের বই যেহেতু হাতে হাতে চলছে, কাটতি ভালো। এই দুর্দিনে বইটার সদব্যবহার করি।’ কীরকম ব্যবহার? না, বন্ধুর বইটা নিয়ে শিবরাম সটান বিক্রি করে দিয়েছিলেন এমসি সরকারে! শুনে হাঁ প্রেমেন্দ্র মিত্র।
এই ‘দুর্দিন’ চিরকালই ছিল শিবরামের। প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও একটা সময় প্রচণ্ড আর্থিক অনটন ছিল। দুই বন্ধুর কারোরই চাকরি নেই। শিবরামের তো সেসব ধাতে সইবে না; কিন্তু তাঁকে তো করতে হবে কিছু একটা। এত ভালো একজন ছাত্র তিনি। কাজের জন্য চলে গেছেন ঢাকায়। হঠাৎ শিবরামের চিঠি। ‘শীঘ্রই কলকাতা আসো, তোমার চাকরি হয়ে গেছে।’ প্রেমেন্দ্র মিত্র তো কিছুই ভেবে পেলেন না। তিনি এখানে, আর কলকাতায় চাকরি কী করে হয়ে গেল? শিবরাম কী করল আবার? কলকাতায় ফিরে সেই অফিসের ঠিকানায় পৌঁছে শুনলেন এক অদ্ভুত ঘটনা। অফিসার বললেন, যাকে বেছেবুছে নিলাম, সে-ই কিনা বলছে চাকরি করবে না। করবে বন্ধু প্রেমেন্দ্র! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য কল্পনা করা সত্যিই খুব কঠিন। এমনই ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র আর শিবরাম চক্রবর্তী…
ঘুরতে যাওয়া দিয়ে দুজনের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল। আর এই ভ্রমণ নিয়েই প্রেমেন্দ্র’র জীবনে হাজির হয়েছিলেন আরও এক পুরুষ। বলা ভালো, ‘সিংহপুরুষ’। ‘পৃথিবীর হেন জায়গা নেই যেখানে তিনি যাননি, হেন ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ নেই’। ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনে বসবাসকারী এই মানুষটির ভালো নাম শ্রী ঘনশ্যাম দাস। কিন্তু গোটা বাংলার কাছে তিনি ‘ঘনাদা’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের তৈরি করা এভারগ্রিন চরিত্র; যার বয়স কখনও থেমে যায় না। কতই না জায়গা ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি! ঠিক যেমনভাবে সিনেমা হলে বসে ঘুরছিলেন প্রেমেন্দ্র আর শিবরাম। ১৯৪৫ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকীতে প্রথমবার বেরোল ঘনাদার গল্প ‘মশা’। বাঙালির চিরন্তন বিপ্লবী সত্তা নিয়ে জেগে উঠেছিলেন; তা কি আড়ালে প্রেমেন্দ্র মিত্রেরই স্বর? ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধেই যত রাগ ঘনাদার। চোখের সামনে যেন আয়না তুলে ধরতে ব্যস্ত সবসময়। পেছনে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির দিকেও সেই একই আয়না তুলে ধরতে চান তাঁর সৃষ্টিকর্তাও। আচ্ছা, আজকের এই অদ্ভুত লোভসর্বস্ব পৃথিবীতে ঘনাদাকে খোঁজা যায় না? তিনি কি আসবেন না নতুন কোনো গল্প শোনাতে? নতুন দিনের কথা বলতে? এসব দেখলে রাগে তাঁর রোগাটে লম্বা চেহারাটা কেঁপে উঠত না বারবার?
সিনেমা দিয়ে গল্প শুরু হয়েছিল। সেখানেই ফিরে যাওয়া শেষ লগ্নে। একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের আরেকটা দিকও ছিল— তাঁর গান আর চিত্রনাট্য। ১৯৩৭ সালে প্রথমবার চিত্রনাট্য লেখেন ‘গ্রহের ফের’ ছবির জন্য। দুবছর পর ‘রিক্তা’; এরপরই শুরু করেন গান লেখার কাজ। সেই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে শুরু করলেও ষাটের দশক পর্যন্ত সেই কাজ চালিয়ে যান তিনি। শচীন দেববর্মণ, নচিকেতা ঘোষ, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকেরা তাঁর গানে সুর দিয়েছেন। আর কণ্ঠে যোগ দিয়েছিলেন কানন দেবী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, শ্যামল মিত্র, রবীন মজুমদার প্রমুখেরা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতাও গানে পরিণতি পেয়েছে পরে। সব মিলিয়ে এও যেন বন্ধুত্বেরই সম্পর্ক। লেখা, গান, সিনেমা, সমাজ; সর্বোপরি জীবন— সবার ভেতর পর্যন্ত না দেখতে পারলে লেখা আসবে কেমন করে!
আরও পড়ুন
সভা-সমিতিতে নয়, বিরলে বসে নিঃশব্দে পড়ার কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন নিশীথ ভড়
Powered by Froala Editor